ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের ইতিহাসের প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের গেটের সামনে থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে টিএসসি’র দিক, তার দুই পাশের উঁচু গাছগুলো ঠিক কতটা পুরোনো তা জানা নেই। এই রাস্তা ধরেই শুভ্র পোশাক পরে হেঁটে গিয়েছিলেন এক দল তরুণ তরুণী। শাখা মেলে ধরে তাদের ছায়া দিয়েছিল সুউচ্চ গাছগুলো। তাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিচঢালা পথ।

ষাটের দশকে যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য লড়াই করছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতৃত্বই স্বপ্ন বোনা শুরু করে একটি স্বাধীন দেশের। নতুন দেশের পতাকা সদর্পে তুলে ধরেন তারাই। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে দীর্ঘ বৈঠকে ছাত্র নেতারাই দাবি তোলেন স্বাধীনতার ঘোষণার।

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানেরও কেন্দ্র ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। তেমনি যখন ২০০৭ যখন সেনাবাহিনী-তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে ক্ষমতা দখল করে নেয় তখনো প্রথম প্রতিবাদ আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেইবার রাতের অন্ধকারে তারা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়, তখনকার মতো আন্দোলনটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিবাদের আগুন মরে না, অপেক্ষায় থাকে আবারও জ্বলে ওঠার। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে মঈন উ আহমেদ-ফখরুদ্দীন আহমদ সরকার বুঝতে পারে অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না, ফিরতে হবে গণতন্ত্রের পথে।

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুটাও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বারবার যখন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন বিফলে যাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্ব তাদের দাবি আদায় করে ছাড়ে। এই আন্দোলনের সম্মুখ সারির নেতা নুরুল হক নুর ২০১৯ সালে ডাকসু’র ভিপি নির্বাচিত হন। তার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা নাহিদ-আসিফরাই আবার ২০২৪ এসে হয়ে ওঠেন জাতির ত্রাণকর্তা।

ষাটের দশকে যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য লড়াই করছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতৃত্বই স্বপ্ন বোনা শুরু করে একটি স্বাধীন দেশের। নতুন দেশের পতাকা সদর্পে তুলে ধরেন তারাই।

২০২৪ সালের আন্দোলন যখন এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একটু একটু করে দানা বাঁধছিল, তখন কেউই আঁচ করতে পারেননি কতদূর গড়াবে এই লড়াই। তবে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল খুব দ্রুত এই আন্দোলনকে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারা এবং সারা দেশের ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে এই দ্রুত এবং কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপন করা।

যে কারণে সুদূর রংপুরের শহীদ আবু সাঈদ হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রতীক। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমন্বয়করা পুরো আন্দোলনের ধমনির মতো কাজ করছিলেন। তাই কোনো কোনো সমন্বয়ককে আটক করা সম্ভব হলেও আন্দোলনকে দমিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি।

আজ ডাকসু নির্বাচনে বিভিন্ন পদের জন্য যারা লড়াই করছেন তাদের মধ্যে উমামা, আবিদ, কাদের, বাকের, মেঘমল্লার কিংবা সাদিকরা আন্দোলনের পরিচিত মুখ। এরাই মাত্র এক বছরের কিছু বেশি দিন আগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, জীবন বাজি রেখেছেন, মুক্তি এনে দিয়েছেন দেশের মানুষের জন্য।

আজ তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এ লড়াইয়ের অন্যতম ক্ষেত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সেখানে কে যে আসল, কেইবা নকল, তা বোঝা বড় দুষ্কর। তাই সেখানে বোধকরি কাদা ছোঁড়াছুড়ি সবচেয়ে বেশি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা করা হচ্ছে, তাকে চোখে দেখা যায় না, যে গালি দিচ্ছে দেখা যায় না তাকেও। তাই মনের অর্গল ভাঙা ঘৃণার ঝাঁপি উগড়ে দেওয়ার অবারিত সুযোগ সেখানে। প্রায় সব প্রার্থীই তাদের বিরুদ্ধে সাইবার বুলিং এবং মিথ্যা প্রচারের অভিযোগ করেছেন, এমনকি পরিবারের ওপরে হুমকির অভিযোগও এসেছে। এর মধ্যে ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের অতিষ্ঠ হয়ে তো বলেই বসলেন, ‘আমার ডাকসুতে জিতা লাগবে না, কেবল বেঁচে থাকতে চাই। এতটুকু দয়া অন্তত আমাকে দেখানোর অনুরোধ।’

নারীরা সাইবার বুলিং-এর সবচেয়ে সহজ টার্গেট উমামা, ইমি’র মতো ভিপি প্রার্থীরা যেমন এর শিকার, তেমনি অন্যরাও এর থেকে ছাড় পাননি। এই বিস্তর চাপান উতরের ভিড়ে সাধারণ ছাত্রদের কল্যাণের আলাপটা খুব একটা হালে পানি পায়নি। নানাভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশলে লড়াইটা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ট্রেন না থামলেও, একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে ব্যাপারটা গণধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায়। এ সবই ভীষণ তিক্ত স্মৃতি হয়ে থাকবে এই নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত সবার জন্যই।

তবু নির্বাচনটা হয়ে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা থেকে আবার এক বছর আগেকার মতো সহযোগী হয়ে ওঠার সুযোগ কি থাকবে? সেটা বোধকরি নির্ভর করবে নির্বাচনটা কেমন হয় আর তার ফলাফল কে, কীভাবে নেয় তার ওপর।

ডাকসুর নানা ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও দিন শেষে এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আর যারা এ নির্বাচনে লড়াই করছেন, তাদের অনেকেই এর চেয়ে অনেক বড় প্রেক্ষাপটে, ক্রান্তিলগ্নে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই তাদের নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। ডাকসু ভিপি বা জিএস-এর পদ তাদের নতুন করে মহিমান্বিত করবে না।

নির্বাচনের ফলে একজন ভিপি হবেন, একজন হবেন জিএস। কিন্তু যারা তা হবেন না, তারা কিন্তু হারবেন না বরং তারা গণতন্ত্রের পথে আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তারা সামনের দিনগুলোয়ও গণতন্ত্রের পরিবেশ তৈরি করতে এবং বজায় রাখতে কাজ করে যাবেন, এটা বোধকরি খুব বেশি চাওয়া নয়। গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা থাকবে, বচসাও থাকবে, কিন্তু দিনশেষে একসাথে পথ চলার পরিবেশটা তৈরি করা জরুরি।

জাতীয় রাজনীতিতেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ। নির্বাচন নিয়ে সংশয় যেমন আছে, তেমনি নির্বাচনের পরে দেশের কী হাল হবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা কম নয়। ডাকসু নির্বাচনের দিকে অনেকে চেয়ে আছেন জাতীয় নির্বাচনের একটা আভাস পাওয়ার আশায়। এখানে নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিও বোধকরি জাতীয় নির্বাচনের পরে দেশের অবস্থার একটা পূর্বাভাস হতে পারে।

...গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা থাকবে, বচসাও থাকবে, কিন্তু দিনশেষে একসাথে পথ চলার পরিবেশটা তৈরি করা জরুরি।

জুলাইয়ের পরে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অনেক আলাপ হয়েছে। এবার সময় এসেছে কাজে তার কিছুটা প্রতিফলন ঘটাবার। এই নির্বাচনে যেই জিতে আসুক না কেন, এতে অংশ নেওয়া সবারই দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচনের আগের বৈরিতার পরিবেশ ভুলে হাতে হাত রেখে চলার একটা পরিবেশ তৈরি করার।

এদেশের মানুষ একছত্র ক্ষমতার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ, অন্যদের সরিয়ে রেখে কেবল এক দল, এক শক্তির আস্ফালন দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। এবারের ডাকসু নির্বাচন এই একঘেয়ে পৌনঃপুনিকতা থেকে দেশকে মুক্তি দেবে, সেই স্বপ্ন দেখতে চাই। কিন্তু এ স্বপ্ন একা একা দেখা যায় না, আবার সবাই মিলে স্বপ্ন দেখলে তা বাস্তবে রূপ নিতেও খুব সময় লাগে না।

চলুন সবাই মিলে আরেকবার স্বপ্ন দেখি!

মানজুর-আল-মতিন : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট