মানুষ কেন অপরাধে জড়ায়?
মানুষ কেন অপরাধ করে? মানুষের অপরাধ করার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে? একজন অপরাধীকে অপরাধ সংঘটনের পেছনে কে বা কারা প্ররোচনা দেয়? অপরাধ সংঘটনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ভূমিকা কী? অপরাধী কীভাবে অপরাধ সংঘটনে আগ্রহী হয়ে ওঠে? ইত্যাদি প্রশ্নগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানের লক্ষ্যে অপরাধবিজ্ঞানের তত্ত্বসমূহ জানা অত্যন্ত আবশ্যক।
বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিপরীতে ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে অপরাধ সংঘটনের বিজ্ঞানভিত্তিক কারণসমূহ জানা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক তথ্য উপাত্ত এবং তত্ত্বের সংযোজনই পারে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক পর্যায়ে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে সঠিক পথে ধাবিত করতে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বজুড়ে অপরাধের ভয়াবহতা ও বৈচিত্রতা বাংলাদেশকে আক্রান্ত করেছে। সংগত কারণেই অপরাধ সংঘটনের কারণসমূহ বিশদভাবে জানার দরকার রয়েছে।
অপরাধপ্রবণতা মানুষের একটি মজ্জাগত বিষয়। যথেচ্ছ সুযোগ পেলে অধিকাংশ মানুষই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অপরাধের সুযোগ পেয়ে অপরাধ সংঘটনে বিরত থেকেছে এমন মানুষের সংখ্যা অপ্রতুল। অপরাধবিজ্ঞানের Opportunity Theory, Rational Choice Theory তত্ত্বে যথেষ্ট সুযোগের প্রাপ্যতা ও উপযুক্ত টার্গেটের সহজলভ্যতা অপরাধ সংঘটনের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
যেকোনো সংঘটিত অপরাধের কার্যকারণ যদি উপস্থাপন করা হয় তাহলে দেখা যাবে, উপযুক্ত মালিকের অনুপস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি, সিসিটিভি ক্যামেরার আওতামুক্ত এলাকা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর অনুপস্থিতি প্রভৃতি কারণে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের সুযোগ পাচ্ছে এবং সুযোগ বুঝেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিজ্ঞাপন
অপরাধপ্রবণতা মানুষের একটি মজ্জাগত বিষয়। যথেচ্ছ সুযোগ পেলে অধিকাংশ মানুষই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে...
অপরাধীরা সাধারণত তাদের প্রয়োজন, চাহিদা, অধিক লাভের আশায়, ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই অপরাধ সংঘটিত করার ব্যবস্থাপনাকে টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, সময়ের সাথে সাথে অপরাধীরা আগের যেকোনো সময় থেকে চালাকচতুর হয়ে উঠছে।
অপরাধ সংঘটনের আলামত ধ্বংস করে নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে অপরাধীরা। কাজেই, সহজলভ্য সুযোগকে কঠিন করে তোলা ও উপযুক্ত টার্গেটকে করায়ত্ত করার পথে বাঁধা হিসেবে দাঁড়াতে পারলেই অপরাধ বহুলাংশে কমে আসবে।
পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজব্যবস্থা নেই যেখানে অপরাধ ও অপরাধী নেই। সংগত কারণেই অপরাধের আধিক্য ও অপরাধীর উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই সমাজ কাঠামো নির্মিত হয়। কেননা প্রত্যেক সমাজ কাঠামোগতভাবে অপরাধমুক্ত ও নাগরিকের জন্য নিরাপদ করার ব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে, অপরাধকে প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রের সক্ষমতা অনুসারে ব্যবস্থা গৃহীত হয়ে থাকে। আবার আধুনিক সমাজে কেবলমাত্র অপরাধ প্রতিকার করেই রাষ্ট্র ক্ষান্ত হয় না রাষ্ট্র, অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। অপরাধের কার্যকারণ অর্থাৎ অপরাধের উৎস, অপরাধ সংঘটনের কারণসমূহ শনাক্ত করা, ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ততার দীর্ঘমেয়াদি অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে কার্যত উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
পৃথিবীর অনেক দেশেই অপরাধের নিম্নমুখীতার কারণে কারাগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যেমন নরওয়ে। বাংলাদেশেও অপরাধকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে অপরাধের প্রকৃত কারণসমূহ চিহ্নিত করে সমন্বিত প্রয়াসের উদ্যোগে অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধের মাধ্যমে সমাজ কাঠামোকে বিনির্মাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা সমন্বিত প্রয়াস ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অপরাধবিজ্ঞানী John Braitwaite তার Reintegrative Shaming, তত্ত্বে দেখিয়েছেন; লজ্জা/নিন্দাকে (Shame) সাধারণত দু’ভাবে দেখা হয়।
প্রথমত, কলঙ্ক (লজ্জা কিংবা অন্যান্য সামঞ্জস্যপূর্ণ উপাদানের কারণে একজন মানুষ ক্রমান্বয়ে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে; যেখানে অপরাধবিজ্ঞানের লেবেলিং তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়)। একজন ব্যক্তিকে যখন সমাজ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে এবং এই পরিস্থিতিতে সেই সমাজে সংঘটিত সব অপরাধের দায় কোনো না কোনোভাবে সেই ব্যক্তির ওপর বর্তায়।
আরও পড়ুন
এ ধরনের লেবেলিং চর্চার কারণে মানুষের মধ্যে মনোবৈকল্য মনোজাগতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিক বিচারবিশ্লেষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সমাজচ্যুত হয়ে বিচ্ছিন্ন কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধ না করেও অপরাধীর তকমা পাওয়ার বিষয়গুলো একজন ব্যক্তিকে বারংবার অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, অপরাধ না করেও যেহেতু অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেহেতু অপরাধ সংঘটন করে দোষের সামিল হওয়াকে অনেকেই শ্রেয় মনে করে।
দ্বিতীয়ত, পুনর্মিলন (অনেক সময় দেখা যায়, নিন্দার কারণে মানুষের মধ্যে বোধোদয়ের সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী সময়ে নিন্দা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে)। একজন ব্যক্তি সমাজে বসবাস করতে গিয়ে তার কোন অপকর্মের কারণে লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে কিংবা লজ্জা পরবর্তী সময়ে সামাজিক সব ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইতিবাচকভাবে জড়িত হয়ে পড়েন এবং ব্যক্তিত্বশীল মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
সামাজিকভাবে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যও এটি, মানুষ যাতে নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং ভুল থেকে সংশোধনের লক্ষ্যে কাজ করে। কিছু কিছু সমাজে দেখা যায়, এ ধরনের ব্যক্তিদের নতুনভাবে জীবন গঠনের লক্ষ্যে সমাজ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে যাতে করে ব্যক্তিজীবনকে নতুন করে শুরু করতে পারে। সুতরাং লজ্জা বা নিন্দা মানুষকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’ভাবেই প্রভাবিত করতে পারে এবং সমসাময়িককালে এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষার্থীকে যদি নেতিবাচকভাবে লেবেলিং করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে তার সহপাঠীদের সাথে স্বাভাবিকভাবে মেলামেশা করতে পারে না, শিক্ষকদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়, মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে পড়ে গিয়ে ধীরে ধীরে স্কুল পালানো শুরু করে এবং পরবর্তীতে ডেলিনকোয়েন্ট গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে অন্যায়, অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
পৃথিবীতে এমন কোনো সমাজব্যবস্থা নেই যেখানে অপরাধ ও অপরাধী নেই। সংগত কারণেই অপরাধের আধিক্য ও অপরাধীর উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই সমাজ কাঠামো নির্মিত হয়।
অন্যদিকে, পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া কিংবা পরীক্ষায় ফেল করার পর শিক্ষকের শাসনকে লজ্জা হিসেবে ধরে নিয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন অনেকেই এবং শিক্ষাজীবনে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। এই তত্ত্বে যে বিষয়টি অত্যন্ত জোর দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটি হচ্ছে—লজ্জার পুনবার্সন সাধারণত ক্রাইম রেটকে কমিয়ে আনে। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে মানুষের বিবেক জাগ্রত হয়, ভালো/মন্দের পার্থক্যকরণ সহজতর হয়।
অন্যদিকে, লজ্জার কলঙ্ক ক্রাইমের হার বৃদ্ধিতে ত্বরান্বিত করে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে মানুষ হিংস্র হয়ে পড়ে, নিজের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং সমাজের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে।
সামাজিক বন্ধন তত্ত্বের (Social Bonding Theory) আলোকে জানা যায়, লজ্জাকে যারা বিবেচনায় নিয়ে লজ্জাকে পদদলিত করে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তাদের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হয় না কিংবা হলেও একেবারে নগণ্য পর্যায়ের। বলা যায়, সমাজকে বিভাজন করতে যারা ভূমিকা পালন করে কিংবা সমাজকে অস্থিতিশীল করে তোলে তাদেরকে যদি সামাজিকভাবে বিচার করা হয়, পরবর্তীতে এ ঘটনাটি সেই ব্যক্তির জীবনে একটি ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তিনি সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। সংগত কারণে সেই ব্যক্তির দ্বারা কোন ধরনের অপরাধ কর্ম সংঘটিত হয় না।
বিপরীতদিকে লেবেলিং তত্ত্বের (Labelling Theory) আলোচনায় উঠে আসে, একজন ব্যক্তিকে যখন লেবেল দিয়ে অপরাধের জন্য চিহ্নিত করা হয়, সেই ব্যক্তিটি কিন্তু সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে এবং এ অবস্থাটি পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিকে একটি ট্রমার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করে এবং ব্যক্তিটি সংক্ষুবদ্ধ হয়ে বারংবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
আবার সমাজ যদি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না (Social Disorganization Theory) হয় তাহলে নগরায়ণ ও স্থানান্তরের কারণে মানুষের মধ্যে বহুবিধ উপায়ে সাম্প্রদায়িকতাবাদ জন্ম নেয়। এ ব্যাপারগুলো মানুষকে অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে প্ররোচনা প্রদান করে থাকে।
উপরের আলোচনায় বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে তথা বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনার ভিত্তিতে সমাজের মূল ভিত তৈরিতে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণ করে উদ্ভূত কারণগুলোকে সমাজ থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে কাজ করতে হবে। সুন্দর, কল্যাণকর ও নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রত্যেককেই যার যার জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ও কর্মক্ষম ভূমিকাই একটি সমাজকে আলোর সন্ধান দিতে পারে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়