ডেঙ্গু, বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। এটি এমন এক রোগ যা প্রতি বছর বর্ষা এলেই আমাদের জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসে। আমরা এর লক্ষণ চিনি, এর বাহক এডিস মশার সাথে পরিচিত এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কেও অবগত।

এত পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও কেন আমরা ডেঙ্গুর মতো একটি রোগের প্রতিকারে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি? কেন এটি প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে আক্রান্ত করছে এবং প্রতি বছর অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে? এটি কি আমাদের উদাসীনতা, অসচেতনতা নাকি অপরিপক্বতা?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যর্থতা কোনো একটি একক কারণে নয় বরং এটি আমাদের উদাসীনতা, অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, অপর্যাপ্ত জনসচেতনতা এবং কার্যকরী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব—এই সবকিছু মিলে তৈরি একটি জটিল সমস্যার প্রতিফলন।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের ব্যর্থতাকে শুধুমাত্র উদাসীনতা বা অপরিপক্বতা—এই দুটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা কঠিন। বরং এটি একটি মিশ্র সমস্যা।

আমাদের সমাজের একটি বড় অংশ উদাসীন যারা ডেঙ্গুকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। যতক্ষণ না রোগটি তাদের নিজেদের বা নিকটজনের ওপর আঘাত না হানছে, ততক্ষণ তারা সতর্ক হন না।

মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে না দেওয়া, পরিষ্কার করা—এই সাধারণ নিয়মগুলো জানার পরেও অনেকেই মেনে চলেন না। ‘আমার কিছু হবে না’ এই ধরনের মনোভাব আমাদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।

এমনকি সরকারি পর্যায়েও অনেক সময় দেখা যায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করার পরই কেবল তোড়জোড় শুরু হয়। বছরের অন্যান্য সময় মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি উদাসীনতা ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ।

সরকারি পর্যায়েও অনেক সময় দেখা যায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করার পরই কেবল তোড়জোড় শুরু হয়। বছরের অন্যান্য সময় মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।

তবে শুধুমাত্র উদাসীনতা দিয়ে পুরো চিত্রটা বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের ব্যবস্থাপনার মধ্যেও যথেষ্ট অপরিপক্বতা রয়েছে। সেইসাথে ডেঙ্গু মোকাবিলার জন্য আমাদের সুসংহত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলেও সেসবের বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে।

প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে আমরা কেবল ফগিং বা মশা মারার স্প্রে করার উপর নির্ভর করি যা কার্যকর হলেও তা সমস্যার মূল উৎপাটনে সক্ষম নয়। মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার জন্য বছরব্যাপী যে কার্যক্রম প্রয়োজন তার অভাব রয়েছে।

এছাড়াও রয়েছে পর্যাপ্ত গবেষণা ও ডেটা সংরক্ষণের অভাব। ডেঙ্গু মোকাবিলায় ভাইরাসের ধরন বা মশার আচরণ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং ডেটা সংগ্রহের কোনো বিকল্প নেই।

কোন এলাকায় কোন ধরনের এডিস মশা বেশি, কোন পরিবেশে তারা বংশবৃদ্ধি করছে এবং ভাইরাসের কোন স্ট্রেইনটি বেশি সক্রিয়—এই ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে যদি ব্যবস্থা নেওয়া যেত তাহলে তা আরও কার্যকর হতো। ব্যক্তি বা স্বল্প পরিসরে এই কাজ করা হলে এত বছরে গোটা দেশের ডাটা সংরক্ষিত হওয়ার কথা ছিল।

এসবের পাশাপাশি জনসচেতনতা কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা ভীষণ জরুরি। যদিও ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয় তবে তার অধিকাংশই কেবল বর্ষার সময়েই সীমাবদ্ধ থাকে। বছরব্যাপী এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো কার্যকর ক্যাম্পেইনের অভাব রয়েছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের ব্যর্থতার পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে সেগুলোর আশু সমাধান জরুরি। দীর্ঘদিনের দুর্বল ও অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা এর মধ্য অন্যতম কারণ। ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরগুলোয় অপরিকল্পিত নগরায়ণ ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যেখানে সেখানে খোলা ড্রেন এবং নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকা—এসবই এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর মশক নিধন কার্যক্রম প্রায়শই প্রয়োজন নির্ভর এবং অপর্যাপ্ত হয়। শুধুমাত্র ফগিং করে উড়ন্ত মশা মারা হয় কিন্তু লার্ভা ধ্বংস করার দিকে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় না।

ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যার প্রভাবও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে গেছে। এখন হঠাৎ করেই প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয় যা পানি জমে থাকার সুযোগ তৈরি করে। একই সাথে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিও মশার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা হলেও আমাদের স্থানীয় পরিবেশগত অব্যবস্থাপনা একে আরও ভয়াবহ করে তুলছে।

ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে তখন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এরমধ্যে হাসপাতালে বেড সংকট এবং ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটের অভাব উল্লেখযোগ্য। এসব কারণে ডেঙ্গু রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় যার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। সঠিক সময়ে সঠিক এবং দ্রুত চিকিৎসার অভাব অনেক সময় রোগীর জীবনহানির কারণ হয়।

সামাজিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতার অভাব একটি বড় সমস্যা। অনেকেই নিজের বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে দেন, টবে বা এসি থেকে পড়া পানি সরান না এবং মশার কয়েল বা স্প্রে ব্যবহারের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখেন। এই ব্যক্তিগত উদাসীনতা সামাজিক পর্যায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধের সামগ্রিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়।

ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয় তবে তার অধিকাংশই কেবল বর্ষার সময়েই সীমাবদ্ধ থাকে। বছরব্যাপী এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানোর মতো কার্যকর ক্যাম্পেইনের অভাব রয়েছে।

এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে এই অসম যুদ্ধে জিততে হলে আমাদের মানসিকতা এবং কর্মপদ্ধতি—উভয় ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগগুলো শুধু বর্ষার সময়ে নয়, সারা বছর ধরে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য চালাতে হবে। সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারলে কাজের গতি তরান্বিত হবে। মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করা এবং লার্ভা ধ্বংসের ওপর জোর দেওয়াও খুব জরুরি।

বিভিন্ন উন্নত নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণা মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে বায়োলজিক্যাল নিয়ন্ত্রণ বা জেনেটিক্যালি মডিফাইড মশার (যদি তা পরিবেশের জন্য নিরাপদ হয়) ব্যবহার করা যেতে পারে। একই সাথে ডেঙ্গু ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন ও মশার আচরণ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।

এই মুহূর্তে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। শুধুমাত্র ফগিং নয় বরং জনসচেতনতাকে একটি আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা—সব জায়গায় ডেঙ্গু প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে অবশ্যই তাদের নিজ নিজ বাড়ির পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিতে হবে।

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আরও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত সংখ্যক হাসপাতাল বেড, আইসিইউ, ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট, চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিশ্চিত করা জরুরি।

বর্তমানে ডেঙ্গু আমাদের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই রোগের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যর্থতা শুধু অসচেতনতা বা উদাসীনতার ফল নয় বরং এটি একটি জটিল পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় ব্যবস্থাপনার সংকট।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব আছে। এটি কেবল সরকারের একার দায়িত্ব নয় বরং এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যতক্ষণ না আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে সচেতন হচ্ছি এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি ও সুসংহত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ না করছি ততক্ষণ ডেঙ্গুর এই চক্র থেকে আমরা বের হতে পারব না।

ডা. কাকলী হালদার : এমবিবিএস, এমডি (মাইক্রোবায়োলজি), সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ