মনজুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকের গোড়ার দিকে। সম্ভবত আফতাব আহমদই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তখন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। আর, সামান্য লেখালেখি করি। তখনো আমার বিশ্বসাহিত্য তেমন পড়া হয়নি। তবে, আফতাব বা তুষার দাশের সঙ্গে যে ক’বার গেছি, তিনি কথা বলতেন প্রধানত বিশ্বসাহিত্য নিয়েই।

ইংরেজি সাহিত্যের পাশাপাশি কথা বলতেন ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান বা রুশ সাহিত্য নিয়ে। কথা বলতেন চিত্রকলা ও সংগীতসহ শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম নিয়েও। অন্যদের কথা জানি না, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আমি মুগ্ধ হতাম এবং একই সঙ্গে তিনি যেসব লেখক-কবির নাম বলতেন তা মাথায় টুকে রাখতাম। সেগুলো জোগাড় করে পড়ার চেষ্টা করতাম। সে সময়েই তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মিলান কুন্ডেরা, সালমান রুশদি; এমনকি নিকানোর পাররা বা হোর্হে লুইস বোর্হেসের সাহিত্যকর্ম নিয়ে বলতেন। আমি নিজেও কখনো কখনো একা একা ইংরেজি বিভাগে তার রুমে চলে যেতাম।

আমি যে নিয়মিত যেতাম তাতে তিনি কখনো বিরক্ত হয়েছেন, এমন মনে পড়ে না। বরং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি বলে যেতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এটা বলতেই হয়, তার ওখানে গেলে সহজে ওঠা যেত না। ফলে আমাকে সিগারেট খাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে উঠে যেতে হতো। একবার ওয়াশরুমের কথা বলে বাইরে বেরিয়েছি এবং কিছুক্ষণ পর সিগারেট খেয়ে তার রুমে ঢুকতেই বললেন, কী, সিগারেট খেতে গিয়েছিলে?

আমি আমতাআমতা করে বললাম, জ্বি।

তিনি হেসে বললেন, সিগারেট টানার জন্য কষ্ট করে বাইরে যাওয়ার দরকার কী? আমার এখানেই খাও। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও সিগারেট তো কোনো নিষিদ্ধ জিনিস না। আমার রুমেই খেতে পারো, চাইলে কখনো কখনো আমাকেও একটা-দুটো দিতে পারো।

তারপর একটু থেমে বললেন, শোনো, সিগারেটের সঙ্গে সম্মান বা শ্রদ্ধার কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। তুমি কারও সামনে বসে সিগারেট খেয়েও তাকে সম্মান করতে পারো। আবার কারও সামনে হয়তো সিগারেট খাও না, কিন্তু তাকে যে তুমি শ্রদ্ধা করো, সেটা নাও হতে পারে। বুঝছো? নাকি বোঝো নাই?

আমার মনে হলো, এর চাইতে কঠিন সত্য আমি জীবনেও শুনিনি। আমি সেদিন বাইরে থেকে খেয়ে এলেও আরেকবার প্যাকেট বের করে নিজে একটা ধরালাম, তাকেও একটা দিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে চেহারা আমি দেখে আসছিলাম, তিনি তা একেবারে ভেঙেচুড়ে দিয়ে নতুন এক রূপে আমার সামনে আবির্ভূত হলেন। আমি সেদিনই ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনাকে ‘স্যার’ না বলে কী সম্বোধন করা যায়, ভাবছি।

তিনি হেসে বললেন, যেকোনো নামে তুমি ডাকতে পারো। সম্বোধন নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নাই। তুমি মনজুর ডাকতে পারো, মনজুরের আগে একটা জনাব বসাতে পারো, এমনকি মনজুরের পর একটা ভাইও বসিয়ে দিতে পারো। একটু থেমে তিনি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, কেবল মনজুর আঙ্কেল ডাইকো না। আমার মনে হয়, আমি অত বৃদ্ধ হইনি।

পুরান ঢাকায় যেখানে একদিনের বড় কারও সামনেই সিগারেট খাওয়া যায় না, সেখানে তিনি আমাকে সেই সুযোগ দেওয়ায় আমি যেন একদিনেই কিছুটা বড় হয়ে উঠলাম।

ধীরে ধীরে এমন হলো, মনজুর ভাইয়ের ইংরেজি বিভাগের সেই ছোট্ট রুম থেকে আমাদের জায়গা হলো এলিফ্যান্ট রোডে তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতেও। এক সময় মনজুর ভাইয়ের বাড়িতেও আমাদের নিয়মিত যাতায়াত চলতে শুরু করলো। এক সময় আমরা ভাবির স্নেহও লাভ করলাম।

...তুমি মনজুর ডাকতে পারো, মনজুরের আগে একটা জনাব বসাতে পারো, এমনকি মনজুরের পর একটা ভাইও বসিয়ে দিতে পারো। একটু থেমে তিনি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, কেবল মনজুর আঙ্কেল ডাইকো না। আমার মনে হয়, আমি অত বৃদ্ধ হইনি।

সেটা এক পর্যায়ে এমন অবস্থায় পৌছুলো যে, দুপুরে খাবারের পয়সা না থাকলে আমরা কখনো কখনো তার বাড়িতে হানা দিতাম। এমনকি কখনো কখনো মনজুর ভাইয়ের অনুপস্থিতিতেও। মনজুর ভাই একবার বলেও বসলেন, আমার বন্ধুরা যা পারেনি, তোমরা দেখি সেটা করে ফেলেছো?

আমরা তার দিকে তাকালে তিনি বললেন, তোমার ভাবি আমার খুব কম বন্ধুকেই পছন্দ করে। তোমরা ওকে পটালে কীভাবে, বলো তো?

ধীরে ধীরে আমি কখন মনজুর ভাইয়ের শিষ্য, আর তিনি আমার মেন্টর হয়ে উঠেছেন আমি টেরও পাইনি। তিনি সত্যি সত্যিই একদিকে আমার মেন্টর এবং অন্যদিকে আমার অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন।

আশির দশকের মাঝামাঝি আমি চাইছিলাম নিজের মতো কিছু কবিতা লিখতে। যেটা ঠিক প্রচলিত ধারার নয়। তিনি আমার সেই প্রচেষ্টাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। বলতেন, প্রচলিত ধারার সাহিত্য করে আসলেও কোনো লাভ নেই। এমন কিছু লিখতে হবে, যেটা আর কেউ লিখছে না। তিনি নিকানোর পারার উদাহরণ দিতেন, শার্ল বোদলেয়ারের উদাহরণ দিতেন। এমনকি ফ্রানৎস কাফকা ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উদাহরণ দিতেন। একবার আমার একটি কবিতার অনুবাদও তিনি করে দিয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে আমি যা শিখিনি, আমি তা শিখেছি তার কাছ থেকে। একজন শিক্ষক হলেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের মতো ছিলেন না। ছাত্র-শিক্ষক-অছাত্র-অশিক্ষক সবার সঙ্গেই তিনি মিশে যেতে পারতেন। শিক্ষকদের স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বা অহমিকা তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। বরং তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে কবি স্বভাবের।

একবার দেখা গেলো, তিনি ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে মিলে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করে দিয়েছেন! এমন একটা কাজ আমার মনে হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব। কোনো লেখকের পক্ষেও কাজটা কঠিন। বয়সে পঁচিশ বছরের ছোট কোনো লেখকের সঙ্গে আর কোনো লেখক যৌথভাবে উপন্যাস লিখবে বলে আমার মনে হয় না।

মনজুর ভাই নিজে যখন ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন তখন বাংলাভাষার প্রচলিত ধারাকে পাশ কাটিয়ে তিনি নিজেও লিখেছেন নতুন ধারার গল্পই, যে গল্পগুলো একান্ত তারই।

এক সময় ভাবতাম, আমিই বুঝি তার একান্ত প্রিয়। আমাকেই বুঝি তিনি এমনটা গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ আমার বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানে তাকে নিমন্ত্রণ করলে তিনি ঠিকই আমাদের বাবর রোডের বাড়িতে এসে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন! এমনকি তিনি আমার ৫০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও এসে হাজির হয়েছিলেন!

এক সময় অবশ্য লক্ষ করে দেখি, তার সঙ্গে আমার এমনসব ব্যক্তিগত আলাপও হচ্ছে, যা আমি আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গেও করতে দ্বিধা করেছি। তার মানে, তিনি এক সময় আমার বন্ধুও হয়ে উঠেছিলেন। মনজুর ভাই যে কেবল আমার একার বন্ধু, আমার একার মেন্টর হয়ে উঠেছিলেন তা নয়। এক সময় টের পাই, তার বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয়ে গেছে এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও।

সব বয়সের, সব ধর্মের, সব মত ও পথের মানুষের সঙ্গে তিনি অবলীলায় এই যে মিশে যেতে পারতেন, এটা কোনো সাধারণ গুণ নয়। এদেশে কম খ্যাতিমানকে তো আর দেখিনি, সব বয়সের সঙ্গে, সব মত ও পথের মানুষের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতে পারা খুবই কঠিন কাজ। তার এই সহজ ভঙ্গিটাই তাকে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

কয়েকদিন আগে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার বন্ধু ও শুভার্থীদের পোস্টে ফেসবুক সয়লাব হয়ে যায়। এত অসংখ্য মানুষ তাকে ভালোবাসে দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। কারও কারও লেখায় এটাও স্পষ্ট যে, তিনি ছিলেন তাদের অত্যন্ত নিকটজন। এত মানুষ তার নৈকট্য লাভ করেছে দেখে বিস্ময় জাগে। এর অর্থ তিনি সব ধরনের মানুষকেই গুরুত্ব দিতেন। কাউকে তিনি ছোট বা বড়-এভাবে দেখতেন না।

কয়েক বছর আগের কথা। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু ব্যাংকক ভ্রমণে গেলাম। সেই দলে আমি ও মনজুর ভাই ছাড়াও ছিলেন কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের, কবি মারুফুল ইসলাম, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ও লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কমল।

সিঙ্গাপুর থেকে ব্যাংককে এসে যোগ দিয়েছিলেন শহিদ হোসেন খোকন। সেবার আমরা এক অর্থে বলা যায়, হোটেল থেকেই বেরোইনি। দিনরাত আড্ডা দিয়েই কাটিয়েছি। একদিন আমরা প্রায় দুপুরে সেন্ট্রাল ওয়ার্ল্ডে গেলাম। মনজুর ভাই নিজের জন্য জামাকাপড় দেখছেন। আমি ছিলাম তার কাছাকাছি। তিনি বললেন, ফরিদ, তুমিও কিছু নাও?

আমি বললাম, মনজুর ভাই, এখানে সবকিছুরই অনেক দাম।

তিনি বললেন, আরে, দামের কথা ভেবো না, তুমি একটা শার্ট পছন্দ করো, আমি কিনে দিচ্ছি।

আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো। যারা সেন্ট্রাল ওয়ার্ল্ডে গেছেন তারা জানেন, সেখানে জামাকাপড়ের দাম একটু বেশিই। কিন্তু মনজুর ভাই আমার দ্বিধা দেখে নিজেই একটা শার্ট পছন্দ করলেন এবং বললেন গায়ে দিয়ে দেখো তো ঠিক আছে কিনা? চেক শার্ট তুমি পছন্দ করো তো?

...তার সঙ্গে আমার এমনসব ব্যক্তিগত আলাপও হচ্ছে, যা আমি আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গেও করতে দ্বিধা করেছি। তার মানে, তিনি এক সময় আমার বন্ধুও হয়ে উঠেছিলেন। মনজুর ভাই যে কেবল আমার একার বন্ধু, আমার একার মেন্টর হয়ে উঠেছিলেন তা নয়।

আমি সেটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলে তিনি আমাকে ধমক লাগালেন, আরে গায়ে দিয়ে দেখো তো মাপ ঠিক আছে কিনা? তোমার মনজুর ভাই তোমাকে একটা শার্ট কিনে দিতে পারবে না?

তিনি সেবার প্রায় জোর করেই আমাকে সেই শার্টটা কিনে তার প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।

কয়েক বছর আগে আমার মেয়ে মুগ্ধ চন্দ্রিকার একটি কবিতার বই বেরোবে। শুনে বললেন, আমি কিন্তু মুগ্ধর কবিতা খুবই পছন্দ করি। ফেসবুকে ওর বেশকিছু কবিতা আমি পড়েছি। কোথাও ওর একটা গদ্যও আমি পড়েছি। তোমার মেয়ের ইংরেজি খুব ভালো। ওকে বলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও ওর মতো ইংরেজি জানে না!

শুনে আমার মন ভরে গেলো। নিজের মেয়ে প্রশংসা কার না ভালো লাগে! তিনি একটু থেমে বললেন, তোমার মেয়ের পাণ্ডুলিপিটা আমাকে পাঠিয়ে দিও, আমি একটা ভূমিকা লিখে দেবো। আমি তো কামরুল হাসান শায়কের মেয়ে ও সিদ্ধার্থ হকের ছেলের বইয়ের ভূমিকাও লিখে দিয়েছি। আমাদের বাচ্চাদের আমরা প্রমোট না করলে কে করবে বলো?

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে যখন শুনলেন আমার প্রথম উপন্যাস ‘নীল মাকখির চোখ’ বের হচ্ছে তখন বললেন, তোমার পাণ্ডুলিপি আমাকে পাঠিয়ে দিও। বই বেরোনোর আগেই আমি পড়ে দেখতে চাই। তারপর মাজহারের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আমি সেন্সর ছাড়পত্র না দিলে কিন্তু বই বেরোবে না।

অনুজ লেখক-কবিদের এভাবে প্রাণিত করেছেন—এমন লেখক আমাদের দেশে কজন আছে?

মনজুর ভাইয়ের সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিলো নাসরীন জাহান-আশরাফ আহমদ দম্পতির বাসায়। সেদিন কথা হয়েছিল, অক্টোবর মাসে একদিন আমার বাসায় আসবেন, আড্ডা হবে।

কিন্তু অক্টোবর আসতে না আসতেই তিনি আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেলেন, এমনকি আমাদের ছেড়ে চলেও গেলেন!

মনজুর ভাই সারাজীবনই কথা রেখেছেন। এবারই আমাদের বাসায় আসবেন কথা দিলেও আসেননি। আর, আসবেন না। এই দুঃখ অনেকদিন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে।

স্কুলজীবন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কত শিক্ষকের দেখা আমি পেয়েছি। মনজুর ভাই সরাসরি আমার শিক্ষক না হলেও তার কাছ থেকেই শিখেছি অনেক বেশি। কারণ তিনি আসলে শিল্পসাহিত্যের কথা বললেও, শ্রেণি-ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে মানুষকে কীভাবে ভালোবাসা যায়—সেই মন্ত্রই শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। শিল্প বলি, সাহিত্য বলি—তা তো শেষ পর্যন্ত মানুষেরই জন্য।

মনজুর ভাই সশরীরে না থাকলেও নানা বর্ণের মানুষের মধ্যে তিনি থেকে যাবেন, তার সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে যেমন, তার ভালোবাসার মধ্য দিয়েও। আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে এই যে বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে, এর কারণও তো একটাই, আমাদের সামনে আর কোনো সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নেই!

ফরিদ কবির : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক