বৃষ্টি-খরার দোলাচলে কৃষকের যুদ্ধ চলে
বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ, যেখানে আবহাওয়া ও জলবায়ু ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি ও অতিখরা—এই দুই চরম প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ফসল চাষে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
অতিবৃষ্টির ফলে মাঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, মাটির বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ফসলের শিকড় পচে যায় এবং উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে। ধান, সবজি ও ডাল জাতীয় ফসল বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে অতিখরার সময় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মাটি শুষ্ক হয়ে পড়ে, ফসল পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে শুকিয়ে যায় এবং কৃষকরা সেচনির্ভর চাষে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে বাধ্য হয়। এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ে ও লাভ কমে। অতিবৃষ্টি যেমন বীজ নষ্ট করে, তেমনি অতিখরা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে।
অতএব ফসল চাষের টেকসই উন্নয়নের জন্য জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা ও বৃষ্টিনির্ভর চাষ পদ্ধতির উন্নয়ন অপরিহার্য। অন্যথায় অতিবৃষ্টি ও অতিখরার দ্বৈত প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
বিজ্ঞাপন
বৃষ্টির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ:
বৃষ্টি হলো প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জলচক্রের অংশ, যা পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। বৈজ্ঞানিকভাবে বৃষ্টির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয় জলচক্র বা হাইড্রোলজিক্যাল সাইকেলের মাধ্যমে। সূর্যের তাপে সমুদ্র, নদী, হ্রদ ও অন্যান্য জলাশয়ের পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে উঠে যায়। এই জলীয় বাষ্প বায়ুর ঠান্ডা স্তরে পৌঁছে ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় রূপ নেয়। এই ক্ষুদ্র জলকণাগুলো মিলিত হয়ে মেঘ সৃষ্টি করে।
যখন মেঘে জলকণার সংখ্যা বেড়ে যায় এবং তাদের ওজন বায়ুর দ্বারা ধারণ করা সম্ভব হয় না, তখন সেই জলকণাগুলো পৃথিবীতে নেমে আসে, একেই আমরা বৃষ্টি বলি। এই প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা, ও বায়ুচাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, উষ্ণ অঞ্চলে বাষ্পীভবনের হার বেশি থাকায় সেখানে বৃষ্টিপাতও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। বৃষ্টি সাধারণত তিন ধরনের হতে পারে, সংবহনজনিত বৃষ্টি, পর্বতবৃষ্টি এবং ঘূর্ণিঝড়জনিত বৃষ্টি। সংবহনজনিত বৃষ্টি হয় সূর্যের তাপে বায়ু দ্রুত উপরে উঠলে; পর্বতবৃষ্টি হয় যখন আর্দ্র বায়ু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ঠান্ডা হয়; আর ঘূর্ণিঝড়জনিত বৃষ্টি ঘটে নিম্নচাপের কারণে বায়ু ঘূর্ণন সৃষ্টি হলে।
অনাবৃষ্টি বা খরা হলো এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যখন দীর্ঘ সময় ধরে কোনো অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় না এবং এর ফলে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। বৈজ্ঞানিকভাবে খরার মূল কারণ হলো বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ ও জলচক্রের ভারসাম্যহীনতা।
অতএব বৃষ্টি একটি জটিল কিন্তু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীর জলচক্রকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে এবং কৃষি, পরিবেশ ও জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
খরার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ:
অনাবৃষ্টি বা খরা হলো এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যখন দীর্ঘ সময় ধরে কোনো অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয় না এবং এর ফলে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। বৈজ্ঞানিকভাবে খরার মূল কারণ হলো বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ ও জলচক্রের ভারসাম্যহীনতা।
প্রথমত, বায়ুমণ্ডলীয় পরিবর্তন খরার প্রধান কারণ। যখন কোনো অঞ্চলে আর্দ্র বায়ু প্রবাহিত না হয়ে শুষ্ক বায়ু প্রবাহিত হয়, তখন মেঘ তৈরি হয় না। ফলে বৃষ্টিপাতও কমে যায়। বিশেষ করে এল নিনো (El Niño) বা লা নিনো (La Niña) প্রভাবের কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা পরিবর্তিত হলে বৈশ্বিক আবহাওয়ার ধরণেও পরিবর্তন আসে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মতো অঞ্চলে খরার সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত, জলচক্রের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া খরার একটি বৈজ্ঞানিক কারণ। সূর্যের তাপে অতিরিক্ত বাষ্পীভবন হলে মাটি থেকে আর্দ্রতা দ্রুত হারিয়ে যায়। একইসঙ্গে মেঘ গঠনের প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে, ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়।
তৃতীয়ত, বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণও খরার প্রভাব বাড়ায়। বন ধ্বংসের ফলে স্থানীয় জলবায়ুর আর্দ্রতা কমে যায়, বাষ্পীভবন হ্রাস পায় এবং মেঘ সৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যায়। শিল্প কারখানার ধোঁয়া ও গ্রিনহাউজ গ্যাস বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টি করে, যা জলচক্রে অনিয়ম ঘটায়।
চতুর্থত, মানবসৃষ্ট ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, যেমন অতিরিক্ত সেচ, নদীর প্রবাহে বাঁধ সৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত উত্তোলন, এসব কারণেও খরার প্রকোপ বাড়ে।
আরও পড়ুন
সবশেষে বলা যায়, খরা একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হলেও এর তীব্রতা এখন মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা, বন সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উদ্যোগ নিলেই খরার প্রভাব অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
কৃষিতে বৃষ্টি-ফসলের আশীর্বাদ:
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিভিত্তিক দেশগুলোতে বৃষ্টি ফসল উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান। প্রকৃতির এই আশীর্বাদ কৃষির প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে। বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা বজায় থাকে, যা বীজ অঙ্কুরোদ্গম, গাছের বৃদ্ধি ও ফুল-ফল ধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
সেচনির্ভর কৃষির ক্ষেত্রেও বৃষ্টি একটি প্রাকৃতিক বিকল্প, যা কৃষকের ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। বৃষ্টির পানি মাটিতে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূরণ করে, ফলে খরার সময়ও সেচের জন্য পানি পাওয়া যায়।
একই সঙ্গে বৃষ্টির মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন আংশিকভাবে মাটিতে মিশে গিয়ে প্রাকৃতিক সার হিসেবে কাজ করে। এর ফলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কিছুটা কমে যায়। ফসল যেমন ধান, পাট, গম, ভুট্টা ও ডাল জাতীয় ফসল বৃষ্টিনির্ভর মাটিতে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
তবে অতিরিক্ত বা অনিয়মিত বৃষ্টিপাত কৃষির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অতিবৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে গাছের শিকড় পচে যায়, আবার অনাবৃষ্টি হলে মাটির আর্দ্রতা কমে গিয়ে ফসল নষ্ট হয়। তাই কৃষি উৎপাদনের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রয়োজন সুষম বৃষ্টিপাত এবং আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনা।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে অনিয়ম দেখা দিচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য বিজ্ঞানসম্মত বৃষ্টির তথ্য বিশ্লেষণ, পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং জলবায়ু-সহনশীল ফসল চাষের মাধ্যমে কৃষি টিকিয়ে রাখা সম্ভব। সব মিলিয়ে বলা যায়, সঠিক সময়ে ও পরিমাণে বৃষ্টি ফসলের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ, যা কৃষক ও দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।
অসময়ে অতিবৃষ্টি-ফসলের চ্যালেঞ্জ :
অসময়ে অতিবৃষ্টি বলতে সেই সময়ের বৃষ্টিপাতকে বোঝায়, যখন সাধারণত বৃষ্টির প্রয়োজন থাকে না বা ফসলের বৃদ্ধি সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে। এই অনিয়মিত বৃষ্টিপাত কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ এটি মাটির গঠন, ফসলের বৃদ্ধি ও ফলনের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে অনিয়ম দেখা দিচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রথমত, অতিবৃষ্টির ফলে মাঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ফসল, বিশেষ করে ধান ব্যতীত অন্যান্য শস্য যেমন গম, পাট, ডাল, সবজি ইত্যাদি অতিরিক্ত পানিতে টিকতে পারে না। শিকড় পচে যায়, গাছের অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে গাছ মরে যায় বা ফলন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
দ্বিতীয়ত, অতিবৃষ্টি মাটির পুষ্টি উপাদান ধুয়ে নিয়ে যায়। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ক্ষয় হয়ে মাটির উর্বরতা কমে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে।
তৃতীয়ত, অসময়ের বৃষ্টির কারণে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। আর্দ্র পরিবেশে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ফলে ব্লাস্ট, পাতাঝলসে যাওয়া, পচন ইত্যাদি রোগ দেখা দেয়।
এছাড়া অতিবৃষ্টি ফসল কাটার সময় হলে মাঠে ফসল নষ্ট হয়ে যায়, শুকানোর সুযোগ না থাকায় গুণগত মান নষ্ট হয়। সবশেষে এই ধরনের অনিয়মিত বৃষ্টি কৃষকের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে। বপন, পরিচর্যা ও কাটার সময়সূচি বিঘ্নিত হয়, ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় এবং কৃষকের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ে।
অতএব, অসময়ে অতিবৃষ্টি শুধু প্রাকৃতিক সমস্যা নয়, এটি কৃষি অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই প্রবণতা মোকাবিলায় প্রয়োজন উন্নত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, আবহাওয়া পূর্বাভাসের যথাযথ ব্যবহার এবং জলবায়ু-সহনশীল ফসলের চাষ।
বৃষ্টি ও খরার অস্থির দোলাচলে কৃষক আজ অনিশ্চয়তার মুখে। একদিকে অতিবৃষ্টি ফসল ডুবিয়ে দেয়, অন্যদিকে খরা মাটিকে করে তোলে অনুর্বর। এই প্রাকৃতিক বৈরিতার ফলে কৃষকের পরিশ্রম প্রায়ই বিফলে যায়, জীবিকা হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের এ প্রভাব মোকাবিলায় দরকার টেকসই কৃষি ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকারি সহায়তা। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পিত কৃষি চর্চাই পারে কৃষকের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল করতে।
সমীরণ বিশ্বাস : কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
srb_ccdbseed@yahoo.com