মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে আর্ট ও মিউজিক থেরাপির গুরুত্ব কতখানি?
বর্তমান যুগে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ট্রমা, একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ আজকের সমাজে এক সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় মনোচিকিৎসায় কাউন্সিলিং, সাইকোথেরাপি ও প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি আর্ট ও মিউজিক থেরাপি একটি কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই দুটি থেরাপিতে কথার পরিবর্তে মানসিক চিকিৎসার কৌশলকে সৃজনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। জাপান, আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোয় স্কুল, হাসপাতাল, রিহ্যাব সেন্টার, এমনকি অফিসেও এখন এই থেরাপিগুলোর ব্যবহার বাড়ছে। তবে দেশভেদে এর গ্রহণযোগ্যতা, পেশাগত স্বীকৃতি এবং ব্যবহারের মাত্রা আলাদা।
বিজ্ঞাপন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই থেরাপির ব্যবহার বেশি গড়ে উঠেছে এবং এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কোর্স, সার্টিফিকেশন এবং গবেষণার অনেক প্রমাণ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমাতে, প্রবীণদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এবং কর্মজীবী মানুষের স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখতে এগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি মূল কেন্দ্র হিসেবে এগুলো নিয়ে গবেষণা করছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আর্ট ও মিউজিক থেরাপি এখন আর শুধুমাত্র বিনোদন নয় বরং এটি একটি সমগ্রতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে, যেখানে রোগীর শরীর, মন ও আবেগকে একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
বিজ্ঞাপন
একটা কেস স্টাডির কথা আমি জানাতে চাই। রিমা, ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী। একসময় সে ছিল চঞ্চল, হাসিখুশি আর স্বপ্নে ভরা। কিন্তু হঠাৎ করেই তার জীবনে অন্ধকার নেমে এলো বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, পড়াশোনার চাপ, আর বন্ধুদের থেকে দূরে সরে যাওয়া। ধীরে ধীরে সে একাকীত্বে ডুবে গেল, কথা বলা বন্ধ করে দিলো, এমনকি স্কুলে যাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিলো।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তার রোগকে ‘মৃদু বিষণ্নতা’ বলে শনাক্ত করলেন। প্রথমে রিমার চিকিৎসা শুরু হলো ওষুধ ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে। কিন্তু খুব একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল না। তখন থেরাপিস্ট পরামর্শ দিলেন মিউজিক ও আর্ট থেরাপি নেওয়ার জন্য। প্রথম কয়েকটি সেশনে রিমা শুধু নীরবে বসে থাকত একটি শব্দও বলত না। কিন্তু থেরাপিস্ট তাকে বললেন, ‘আপনি কথা না বললেও রঙ আর সুর দিয়ে আপনার মন যা বলতে চায়, তা বলতে পারেন।’
ধীরে ধীরে রিমা তার আবেগ ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করল। একদিন সে আঁকল একটি অর্ধেক মুখ এক পাশ অন্ধকারে ঢাকা, আর অন্য পাশ আলোর দিকে তাকিয়ে। থেরাপিস্ট জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মুখটা কে?’ রিমা ধীরে বলল, ‘এটা আমি... আমি এখনও আলো খুঁজছি।’
এরপরের সেশনে মিউজিক থেরাপিতে ধীরে ধীরে ওঠা সুরের সঙ্গে সে নিজের মন খুলে কথা বলা শুরু করল। প্রতিটি সুরে সে যেন নিজের ভেতরের ব্যথাকে ছুঁয়ে দেখছিল, আবার মুক্তও হচ্ছিল। দশম সেশনের শেষে রিমা বলল, ‘এখন আমার মনে হয়, আমি আবার হাসতে পারি।’ তার বিষণ্নতা কমে গেছে, রাতে ঘুম আসে, আর সে আবার স্কুলে ফিরেছে। এভাবেই রিমা তার নিজের গল্পটা ‘রঙ আর সুরের মাধ্যমে আবার লিখে ফেলেছে।’
আর্ট ও মিউজিক থেরাপি কী এবং কীভাবে এই থেরাপি কাজ করে?
আর্ট থেরাপি (Art Therapy) এবং মিউজিক থেরাপি (Music Therapy) হচ্ছে সৃজনশীল, অবাচনিক থেরাপি পদ্ধতি, যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। এগুলো এমন মানুষদের সাহায্য করে যারা কথা দিয়ে নিজেদের অনুভূতি বা কষ্ট প্রকাশ করতে পারেন না। এই থেরাপির মাধ্যমে তারা রঙ, ছবি, সুর বা সংগীতের মাধ্যমে নিজেদের মনের গভীর অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারেন।
এগুলো মানুষ নিজেকে বুঝতে, ট্রমা থেকে মুক্ত হতে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই থেরাপি নিতে হলে ব্যক্তিকে আর্ট জানতে হবে না বা সংগীতশিল্পী হতে হবে না। এখানে কাজের মান নয় বরং আবেগ প্রকাশই মুখ্য। তাই যেকোনো বয়সের মানুষ, এমনকি শিশু বা প্রবীণরাও এই থেরাপির মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি পেতে পারেন।
জাপান, আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোয় স্কুল, হাসপাতাল, রিহ্যাব সেন্টার, এমনকি অফিসেও এখন এই থেরাপিগুলোর ব্যবহার বাড়ছে। তবে দেশভেদে এর গ্রহণযোগ্যতা, পেশাগত স্বীকৃতি এবং ব্যবহারের মাত্রা আলাদা।
আর্ট থেরাপিতে বিভিন্ন শিল্পকর্ম যেমন আঁকা, রঙ করা, পেইন্টিং, কোলাজ, মাটির কাজ, স্কেচিং ইত্যাদির মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করা হয়। একজন আর্ট থেরাপিস্ট ব্যক্তিকে এমন পরিবেশ দেন যেখানে সে নিজের মন থেকে কিছু সৃষ্টি করতে পারে। সেই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নিজের অজানা অনুভূতিগুলো চিনতে শেখে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি বিষণ্ন মানুষ হয়তো গাঢ় কালো রঙ ব্যবহার করে তার মানসিক অন্ধকার প্রকাশ করছে বা একটি শিশু তার ভয়ের অভিজ্ঞতা একটি ছবি আঁকার মাধ্যমে প্রকাশ করছে।
আর মিউজিক থেরাপি মূলত সংগীতের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। এই থেরাপিকে সাধারণভাবে চারটি প্রধান ধরনে ভাগ করা যায় রিসেপটিভ, রি-ক্রিয়েশনাল, ইমপ্রোভাইজেশনাল এবং কম্পোজিশনাল।
রিসেপটিভ পদ্ধতিতে সংগীত শোনা হয় মনকে শান্ত করা ও অনুভূতি প্রকাশের জন্য এবং পরে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে থেরাপিস্টের সাথে আলোচনা করা হয়।
রি-ক্রিয়েশনাল পদ্ধতিতে সংগীতের বিভিন্ন উপাদানের সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা হয়, যেমন গান গাওয়া, নাচা বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো। এতে আনন্দ, আত্মবিশ্বাস এবং সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে।
ইমপ্রোভাইজেশনাল পদ্ধতিতে থেরাপিস্ট ও ক্লায়েন্ট একসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে সংগীত সৃষ্টি করেন, যা হতে পারে গানের মাধ্যমে বা যন্ত্র বাজানোর মাধ্যমে।
আর কম্পোজিশনাল পদ্ধতিতে অংশগ্রহণকারীরা নিজের চিন্তা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য গান বা অন্যান্য সংগীত রচনা করে থাকেন। এছাড়াও কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কৌশলের ভিত্তিতেও শ্রেণিবিন্যাস করা হয়, যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল মিউজিক থেরাপি (NMT), নর্ডফ-রবিনস মিউজিক থেরাপি এবং নিউরোলজিক মিউজিক থেরাপি (CBMT)।
এসব পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়তা করা। এই দুটি থেরাপির কিছু মূল দিক তুলে ধরা হলো—
১. সৃজনশীল প্রকাশ: মানুষ সবসময় তার মনের কথা প্রকাশ করতে পারে না। অনেক সময় কিছু আবেগ যেমন ভয়, রাগ, দুঃখ, লজ্জা—মুখে বলা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আর্ট বা মিউজিক থেরাপি মানুষকে একটি নিরাপদ জায়গা দেয় যেখানে সে ছবি আঁকার, রঙ করার, গান গাওয়ার বা কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানোর মাধ্যমে নিজের ভেতরের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে।
২. আবেগের প্রক্রিয়াকরণ: এই থেরাপির মাধ্যমে ব্যক্তি তার জটিল আবেগগুলো অনুধাবন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি ট্রমার মধ্যে থাকে, তবে ছবি আঁকার সময় তার ভেতরের কষ্ট, ভয় বা অস্থিরতা প্রতিফলিত হয়। থেরাপিস্ট সেই চিত্র বা সুর বিশ্লেষণ করে ব্যক্তি কীভাবে তার আবেগের সাথে মোকাবিলা করছে তা বুঝতে পারেন। এতে ব্যক্তি ধীরে ধীরে নিজের অনুভূতিকে গ্রহণ করতে শেখে এবং মানসিক ভারসাম্য ফিরে পায়।
৩. উপসর্গ হ্রাস: গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত আর্ট বা মিউজিক থেরাপি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার উপসর্গ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সংগীত বা রঙের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করলে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিন নামক হরমোন বৃদ্ধি পায়, যা মানসিক প্রশান্তি আনে।
গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা জানিয়েছেন যে কয়েক মাসের থেরাপির সময় তাদের কিছু শারীরিক লক্ষণও উন্নতি করেছে (Monti et al., 2006)। বিশেষ করে মিউজিক থেরাপি শান্তিদায়ক হিসেবে কার্যকর, যা রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের হার কমাতে সাহায্য করে (Wakim et al., 2010)।
৪. জ্ঞানীয় ও সামাজিক উপকারিতা: এই থেরাপিগুলো শুধু মানসিক নয় বরং জ্ঞানীয় (cognitive) ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ করলে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, চিন্তাশক্তি বাড়ে। একই সঙ্গে গ্রুপ থেরাপিতে অংশগ্রহণ মানুষকে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, সহযোগিতা শেখায় এবং সামাজিক সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে।
মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা হিসেবে আর্ট ও মিউজিক থেরাপি
আর্ট বা মিউজিক থেরাপি তখনই মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত হয়, যখন এগুলো কোনো প্রশিক্ষিত ও সনদপ্রাপ্ত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। একজন যোগ্য থেরাপিস্ট রোগীর মানসিক অবস্থা, আবেগ এবং চিন্তার ধারা বুঝে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী সেশন পরিচালনা করেন। এই কাঠামোবদ্ধ থেরাপিউটিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রোগী নিরাপদভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে এবং ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য ফিরে পায়। অন্যদিকে, শুধুমাত্র বিনোদন বা শখের উদ্দেশ্যে আর্ট ও সংগীতচর্চা করলে তা চিকিৎসার মতো কার্যকর হয় না।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংস্থা, যেমন American Art Therapy Association (AATA) বা American Music Therapy Association (AMTA) এই থেরাপিস্টদের প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন প্রদান করে। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে, এই থেরাপি মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধির একটি বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রচলিত চিকিৎসার পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা: উন্নত বিশ্বে এই থেরাপিগুলো সাধারণত প্রচলিত চিকিৎসা যেমন কাউন্সিলিং ও ওষুধের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি রোগীর আত্মপ্রকাশ, মনোযোগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, ফলে অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রভাব আরও কার্যকর হয়।
পেশাগত তত্ত্বাবধান ও কার্যকারিতা: একজন প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট আর্ট বা মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে রোগীর মানসিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে তাকে পরিচালিত করেন। এভাবে থেরাপিস্ট রোগীর সঙ্গে একটি সহায়ক ও বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংস্থা, যেমন American Art Therapy Association (AATA) বা American Music Therapy Association (AMTA) এই থেরাপিস্টদের প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন প্রদান করে। সঠিকভাবে পরিচালিত হলে, এই থেরাপি মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধির একটি বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর উপায় হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত ও গ্রুপ থেরাপি: আর্ট ও মিউজিক থেরাপি উভয়ই ব্যক্তিগতভাবে বা দলীয়ভাবে করা যায়। ব্যক্তিগত সেশনে থেরাপিস্ট এবং রোগীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়, যা আত্ম-অনুসন্ধানে সাহায্য করে। অন্যদিকে, গ্রুপ থেরাপিতে অংশগ্রহণ মানুষকে সামাজিকভাবে সক্রিয় করে তোলে এবং সহযোগিতার অনুভূতি বাড়ায়।
মানসিক স্বাস্থ্যে আর্ট ও মিউজিক থেরাপির গুরুত্ব
আর্ট বা মিউজিক থেরাপি মানুষের ‘আত্ম-অনুভূতি ও আত্ম-মূল্যায়ন’ বাড়ায়। এটি মানুষকে নিজের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত হতে সাহায্য করে, যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। যারা ট্রমা, দুঃখ বা শোকের মধ্যে রয়েছেন, তাদের জন্য এই থেরাপিগুলো একধরনের মানসিক মুক্তির পথ তৈরি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্ন কিশোর-কিশোরীরা নিয়মিত সংগীত শোনার পর তাদের শরীরে স্ট্রেস হরমোন ‘কর্টিসল’-এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে (Hu et al., 2021; Wakim et al., 2010)। এটি প্রমাণ করে আর্ট ও মিউজিক থেরাপি মানসিক চাপ কমাতে কার্যকরী।
তাছাড়া, তাদের মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি (EEG) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ কিশোরের মস্তিষ্কের বাম ফ্রন্টাল অংশে সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ইতিবাচক আবেগ (positive affect) ও আনন্দের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, সংগীত শুনলে শুধু মানসিক স্বস্তিই আসে না বরং মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণের জৈবিক প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন ঘটে।
আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীরা ১০টি মিউজিক থেরাপি সেশন সম্পন্ন করার পর তাদের মানসিক উপসর্গে উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করেছে (Ivanova et al., 2022)। তাদের এই উন্নতি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানসিক মূল্যায়ন স্কেলে পরিমাপ করা হয়।
গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, রোগীরা থেরাপিস্টের সঙ্গে মিউজিকের মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগ বা ‘musical interaction’ এর স্তর বাড়িয়েছে। অর্থাৎ, তারা থেরাপি চলাকালীন সংগীতের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ, মনোযোগ ধরে রাখা এবং সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা উন্নত করতে পেরেছে।
আর্ট ও মিউজিক থেরাপি এখন শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়, এটি একধরনের আত্মিক যাত্রা। এটি ব্যক্তিকে শেখায় কীভাবে মনের গভীরের কষ্টকে রঙ, সুর ও সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্ত করা যায়। বাংলাদেশে আর্ট ও মিউজিক থেরাপি এখনো অনেকটাই নতুন এবং সীমিতভাবে পরিচিত।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো সীমিত, সেখানে এই ধরনের সৃজনশীল থেরাপি বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। এটি এমন রোগীদের মধ্যে আগ্রহ ও অংশগ্রহণ বাড়াতে সাহায্য করে যারা প্রচলিত থেরাপিতে অংশ নিতে অনিচ্ছুক। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে যারা ট্রমা, স্ট্রেস ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা অনুভব করে, তাদের জন্য আর্ট ও মিউজিক থেরাপি মানসিক মুক্তির একটি নিরাপদ পথ হতে পারে।
এই থেরাপিগুলোর মাধ্যমে মানুষ নিজেকে নতুনভাবে চিনতে পারে, নিজের শক্তি ও সৃজনশীলতাকে উপলব্ধি করতে পারে, এবং জীবনের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া মানে কেবল রোগমুক্ত থাকা নয় বরং নিজের আবেগ, চিন্তা ও অনুভূতির সাথে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
ড. জেসান আরা : সহযোগী অধ্যাপক ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
jesan@ru.ac.bd