আমাদের জীবনধারাই আমাদের সংস্কৃতি। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের গর্ব। সংস্কৃতি আমাদের জীবনধারণের প্রতিচ্ছবি। সেই ঐতিহ্য কি ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে? আমাদের সংস্কৃতি কি কয়েকটি উৎসবে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে? এই উত্তরগুলো খোঁজা আজ খুব জরুরি বলে মনে করছি। কারণ অতিমারির সময়ে আমাদের সংস্কৃতির নানা মাধ্যম ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের পরিধিও আসছে কমে।

যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো যুগে যুগে আমাদের সকল রাজনৈতিক অর্জনের সূতিকাগার ছিল, আজ কোথায় সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন? যে ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আমাদের অগ্রজরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন রচনা করেছিলেন, আজও সমাজে সেই অবস্থা বিরাজমান। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রকৃত সাংস্কৃতিক আন্দোলন আমরা রচনা করতে পারছি না। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্ব পাচ্ছে নানা মৌলবাদী গোষ্ঠীর ফতোয়া।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংস্কৃতি যেন এখন রাষ্ট্রীয় পরিচালনার মার্জিনে গিয়ে ঠেকেছে। আবহমান বাংলার সহজ সুন্দর সাংস্কৃতিক আবহকে নস্যাৎ করে, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে জনগণের চোখে ভুলভাল ফতোয়ার ঠুলি পড়িয়ে দিচ্ছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। হাতে গোনা দু’একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন বা দু’একজন সচেতন মানুষ ছাড়া এসবের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদও চোখে পড়ে না। প্রতিহত করা তো দূরের কথা। আমরা কয়জন সুনামগঞ্জের শাল্লায় নির্যাতিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশে দাঁড়িয়েছি? কয়টি সংগঠন রণেশ ঠাকুরের গানঘর ভাঙার প্রতিবাদ করেছি?

এসব অন্যায়ের প্রতিকারে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের ভূমিকা তো আমরা দেখে আসছি। তাদের ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের পক্ষে। আর এই বাস্তবতায় রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা দিয়ে ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করছে।

আমার এ মাটি, বাঙালিসহ বিভিন্ন আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। ইসলাম তো এদেশে আসা একটি ধর্ম। আর ধর্মের চর্চা হবে ঘরে ঘরে, ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে। ইসলামি সংস্কৃতি কি আমাদের এ ভূখণ্ডের সংস্কৃতি? বাংলা সংস্কৃতি চর্চার কয়টি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে উপজেলা পর্যায়ে? হয়তো বলবেন, জেলায় জেলায় শিল্পকলা একাডেমি তো আছে। হ্যাঁ, তা আছে। কিন্তু সেই শিল্পকলা একাডেমিগুলো কি শিল্পীদের হাতে? একেবারেই নয়। সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালিত হয় আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কোথাও কোথাও শিল্পীরা সামনে থাকেন বটে কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলাদের মন-মানসিকতাই গুরুত্ব পায়। এ কারণেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন কয়েক দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবের বাইরে আর যেতে পারে না। তাই শিল্পকলা একাডেমিগুলো ব্যর্থ হচ্ছে শিল্পের বিস্তার আর মানুষের মননকে শিল্পের আলোতে গড়ে তোলার প্রয়াস নিতে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেখানে একটি চলমান প্রক্রিয়া, সেখানে আমরা দিনব্যাপী কয়েকটি পরিবেশনা আর আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যেই বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ রেখেছি। সেটুকু করতে গেলেও প্রশাসনের কত বাধা যে ডিঙাতে হয়, সেটা আয়োজক মাত্রেই বোঝেন।

যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো যুগে যুগে আমাদের সকল রাজনৈতিক অর্জনের সূতিকাগার ছিল, আজ কোথায় সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন? যে ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আমাদের অগ্রজরা সাংস্কৃতিক আন্দোলন রচনা করেছিলেন, আজও সমাজে সেই অবস্থা বিরাজমান।

২০২০-২০২১ সালের বাজেট দেখেও মনে হয়েছে রাষ্ট্রও বোধ হয় সংস্কৃতিহীন করতে চায় আমাদের, বা সাংস্কৃতিক বিকাশ বলতে রাষ্ট্রও দিনশেষে কতগুলো সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আর পরিবেশনাই বোঝে। এত তাচ্ছিল্য আর কোনো খাতে দেখা যায়নি। পুরো বাজেট উপস্থাপনে কয়েকটি সংখ্যা ছাড়া সংস্কৃতির বিষয়ে একটি বাক্যও উচ্চারিত হয়নি।

নতুন অর্থবছরে বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর সাংস্কৃতিক খাতে বরাদ্দ ৫৮৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ০.০৯৭ শতাংশ। যেখানে সংস্কৃতিকর্মীদের বহুদিনের দাবি সাংস্কৃতিক খাতে মোট জিডিপির ১ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হোক।

বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার সিংহভাগ খরচ হয় সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নানা বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধায় আর কিছু সংগঠনের জন্য থোক বরাদ্দে। যেসব সংগঠনকে এ অর্থ দেওয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব সংগঠনের বাস্তবে কোনো কাজ দেখা যায় না। শুধুমাত্র কাগজে কলমেই অস্তিত্ব আছে এমন সংগঠনও পেয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় অনুদান। আবার এমন বড় সংগঠনও আছে যাদের দেশব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ নাম মাত্র। সরকার যেসব সংগঠনকে অর্থ দেয় সে অর্থ সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হয় কি না তারও কোনো হিসাব নেওয়া হয় না। ফলে অনেক অস্বচ্ছতা থেকে যায় পুরো প্রক্রিয়াটিতে।

করোনার সময় লোকশিল্পী, যাত্রাশিল্পী, নাটক-সিরিয়ালের চরিত্রাভিনেতা, রূপ সজ্জাকার, নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীত-নৃত্য প্রশিক্ষক, যন্ত্রশিল্পী, চিত্রশিল্পী যাদের শিল্পচর্চাই জীবিকা, তারা অত্যন্ত অর্থ কষ্টে আছেন। না খেতে পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হ্যাঁ, সরকারের পক্ষ থেকে এই মহামারির শুরুর দিকে একবার কিছু শিল্পীকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে টাকায় কতদিন চলে? ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাহায্য সহায়তা চলছে কিছু। সেও আর কতটুকু। এই যে শিল্পীরা দেশে-বিদেশে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরছেন, যাদের আমরা ‘সমাজের চোখ’ বলছি, তাদের জীবন বাঁচানোর কোনো পরিকল্পনা কি বাজেটে থাকতে পারতো না? এরা কি এদেশের নাগরিক নন?

নতুন অর্থবছরে বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর সাংস্কৃতিক খাতে বরাদ্দ ৫৮৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ০.০৯৭ শতাংশ।

এসব কারণেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক প্রতিভাবান শিল্পী বাধ্য হয়ে বংশ পরম্পরার শিল্পচর্চা ছেড়ে কেউ শহরে আসছেন কুলির কাজ করতে বা রিকশা-ভ্যান চালিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টায়। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিল্পের অনেক ধারা। সংস্কৃতিচর্চার দায় শুধু অনুষ্ঠান করেই শেষ করা যাবে না।

সংস্কৃতিমনা অসাম্প্রদায়িক জাতি তৈরি করতে হলে প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলের মাটির যে সংস্কৃতি তার চর্চা করতে হবে। লালন ফকির, শাহ আব্দুল করিম, আরকুম শাহ, দ্বিজ দাস, বিজয় সরকারের গানের চর্চা ও গবেষণা করতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, পালাগানের আসর করতে হবে। রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত শুধু আওড়ালেই হবে না বা জন্ম মৃত্যুর অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকলেই হবে না, তাদের নিয়ে গবেষণায়ও উদ্যোগী হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। বাজেট বরাদ্দও প্রয়োজন।

সংস্কৃতির অন্যতম শাখা সাহিত্য। এই ক্ষেত্রে সরকারি দৃষ্টি একেবারে নেই বললেই চলে। দু’একটি পুরস্কার দিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে কি কর্তব্য সারা যায়? এই যে মহামারির সময়েও অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজিত হলো, তাতে প্রকাশকরা তো অন্য বছরের তুলনায় কেনা-বেচা করতে পারেনি, কিন্তু এ বিষয়ে কি বাজেটে কোনো দিক-নির্দেশনা আছে?

নীলক্ষেত, বাংলাবাজার বা পল্টনের ফুটপাতে যারা বই বিক্রি করতেন, তাদের অনেকেই পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছেন, আমরা কেউ কি তাদের খোঁজ রেখেছি? এ বিষয়গুলো পোশাকশিল্প বা ভারি ধাতবশিল্পের মতো গালভরা নাম হয়তো নয়, কিন্তু জাতি ও সমাজের মানস বিনির্মাণে তাদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তাছাড়াও গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায় পাঠাগার তৈরি করে প্রজন্মকে বইমুখী করাও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব, ফলে এক্ষেত্রেও বাজেট বরাদ্দ থাকা অত্যন্ত জরুরি।

সবশেষে সরকার, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে অনুরোধ সবাই মিলে মত বিনিময়ের মাধ্যমে, সংস্কৃতিক্ষেত্রে বাজেট কেমন হওয়া উচিত তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে উপস্থাপন করা উচিৎ। প্রতিবার বাজেট আসলে সংস্কৃতি খাতের প্রতি সরকারের এমন মনোভাব নিয়ে আমরা বছর বছর কথা বলছি, কিন্তু সমাধান কিছুতেই হচ্ছে না। সরকারকে বুঝতে হবে, সংস্কৃতি না বাঁচলে জাতির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। তার নমুনাও কি আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি না?

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী