বৈষম্যের মাঝে শান্তি ও টেকসই উন্নয়ন!
স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা নিয়ে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। প্রবৃদ্ধির সাফল্য যতই তুলে ধরা হোক, বাস্তবতা হলো বৈষম্য এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা শুধু উদ্বেগজনক নয়, বরং বিপজ্জনক। সম্পদ, আয়, সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র সমাজের ন্যায়বিচারকে ভেঙে দিচ্ছে এবং উন্নয়নের ভিতকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলছে। উন্নয়নের শুরুতে বৈষম্য বাড়লেও শিক্ষা ও শিল্পায়নের বিস্তারে তা পরে কমে আসে-এই তত্ত্ব দীর্ঘদিন স্বীকৃত ছিল কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এই ধারণাকে খণ্ডন করেছে। গত দুই দশকে ৬-৭ শতাংশ স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তার সুফল সমানভাবে বিতরণ হয়নি; বরং বৈষম্য আরও বেড়েছে।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা এই বাস্তবতাকে আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান এক কঠোর প্রশ্ন রেখেছে শাসকগোষ্ঠীর সামনে, উন্নয়ন কার জন্য, আর কারা তার বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে? দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, ন্যায্যতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে প্রবৃদ্ধির ভিত্তি শক্ত নয়, বরং নড়বড়ে হয়ে পড়ে। উন্নয়ন যখন কাগজে-কলমে অগ্রগতি দেখায়, কিন্তু বাস্তবে বৈষম্য ও বঞ্চনার চক্র গভীরতর হয়, তখন রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে বৈষম্য নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র এখনো আয়বৈষম্যের মধ্যেই আটকে থাকে; অথচ বৈষম্য এর চেয়ে অনেক গভীর ও বহুমাত্রিক। প্রবেশাধিকার, মালিকানা, সুযোগ, কণ্ঠস্বর ও সামাজিক মর্যাদা—প্রায় প্রতিটি স্তরেই বৈষম্যের স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে। গিনি সহগ ইতিমধ্যেই ০.৪৯ অতিক্রম করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম উচ্চ এবং নির্দেশ করে যে প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণের বৃহৎ অংশে পৌঁছায়নি। অর্থাৎ অর্থনীতি বাড়ছে, কিন্তু তার ভাগ পায় অল্প কয়েকজন।
বর্তমানে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের ৫৮.৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বিপরীতে পিছিয়ে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মাত্র ৪.৮ শতাংশ সম্পদ। এই বৈষম্য শুধু সংখ্যার খেলা নয় এটি সামাজিক ন্যায়, জীবনমান ও সুযোগসুবিধার বৈষম্যের নির্মম প্রতিফলন। ভূমি, আবাসন ও আর্থিক সম্পদের মালিকানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য সমাজে নতুন স্তরবিন্যাস তৈরি করেছে। সরকারি স্কুল ও হাসপাতালের মান ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় সামর্থ্যবানরা বেসরকারি সেবা গ্রহণ করছেন, আর নিম্নআয়ের মানুষ বাধ্য হচ্ছেন সীমিত ও নিম্নমানের সরকারি সেবার ওপর নির্ভর করতে। এর ফলে সেবার মানে যে ফাঁকটি তৈরি হচ্ছে তা শুধু বর্তমানের সমস্যা নয় এটি ভবিষ্যতের বৈষম্যও নির্ধারণ করছে। এই বিভাজন কেবল সুযোগ ও জীবনমানের সমসাময়িক পার্থক্য নয়; এটি এক নির্মম আন্তঃপ্রজন্ম বৈষম্যও তৈরি করছে। ভালো মানের স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবায় বেড়ে ওঠা শিশুদের শিক্ষাগত প্রস্তুতি, পেশাগত দক্ষতা ও স্বাস্থ্যগত সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, যা ভবিষ্যতে তাদের আয়ের স্তর ও সামাজিক অবস্থানেও প্রতিফলিত হয়।
অন্যদিকে সীমিত সেবা, অপুষ্টি, দুর্বল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা শিশুদের কর্মজীবনে প্রবেশ ও উন্নতির পথ শুরুতেই সংকুচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ আজকের বৈষম্য শুধু বর্তমানকে নয় আগামী প্রজন্মের সম্ভাবনাকেও পূর্বনির্ধারিত করে দিচ্ছে। যার মানে, এই বৈষম্য চলমান থাকলে সমাজে দারিদ্র্য ও সুযোগবঞ্চনা একটি চক্রে পরিণত হবে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠবে।
লিঙ্গ, জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্য এখনো সমাজের ভাঁজে ভাঁজে গভীরভাবে প্রোথিত। নারী শ্রমিকেরা কম মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং অনিরাপদ কর্মপরিবেশের মতো বৈষম্যমূলক বাস্তবতার মুখে থাকেন; নেতৃত্ব, সম্পদ মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণও সীমিত। তবে সবচেয়ে সূক্ষ্ম, ও বিপজ্জনক বৈষম্য হলো কণ্ঠস্বরের বৈষম্য। নীতি প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ বা উন্নয়ন পরিকল্পনায় নাগরিক সমাজ, শ্রমজীবী মানুষ ও তরুণদের অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। কণ্ঠস্বরহীনতার এই বাস্তবতা শুধু অন্তর্ভুক্তির সংকট নয়; এটি ক্ষমতা ও ন্যায়বিচারের কাঠামোগত ব্যর্থতার লক্ষণ। ফলে বৈষম্য কেবল দৃশ্যমান সম্পদ বা সুযোগের ঘাটতি নয় এটি প্রতিনিধিত্ব, অধিকার ও মর্যাদার গভীর সংকটেও পরিণত হয়েছে।
আর এই বৈষম্যই সমাজে ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও বঞ্চনার সঞ্চয় তৈরি করে। যখন মানুষের অধিকার ও কণ্ঠস্বর অবরুদ্ধ থাকে, সুযোগ সীমিত হয় এবং ন্যায়বিচারের পথ বন্ধ হয়ে যায় তখন সেই বঞ্চনা সংঘাত, বিপ্লবী মনোভাব, জনরোষ, এমনকি সহিংসতার ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। ইতিহাস ও সাম্প্রতিক বাস্তবতা দেখায় যে সমাজে বৈষম্য গভীর, সেখানেই সংঘাত ও অস্থিরতার ঝুঁকি বেশি। অর্থাৎ, বৈষম্য কেবল উন্নয়নকে রুদ্ধ করে না এটি শান্তিকে বিপন্ন করে এবং সহাবস্থানের ভিত্তিকেও ভেঙে ফেলে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে বৈষম্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরুৎপাদিত হয়। রাজস্বনীতি, শিল্পনীতি, আর্থিক খাত ও শ্রমবাজার প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি বৈষম্যকে স্থায়ী করছে। রাজস্ব আয় প্রধানত পরোক্ষ করনির্ভর, যা দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ওপর বেশি চাপ ফেলে; বিপরীতে উচ্চ আয়ের শ্রেণি করছাড় ও প্রশাসনিক ফাঁকফোকরের সুবিধা নেয়, ফলে করব্যবস্থার ন্যায্যতা ভেঙে পড়ে। শিল্পনীতি ও বিনিয়োগ কাঠামো বড় পুঁজিপতি ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের পক্ষে ঝুঁকে আছে। প্রণোদনা, করছাড় ও ব্যাংকঋণ তাদের জন্য, আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সুযোগ পান না। খেলাপি ঋণ, ব্যাংক লুট ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ধনীদের সম্পদ সুরক্ষিত করেছে এবং সাধারণ আমানতকারীর আস্থা ক্ষয় করেছে; ব্যাংক খাত কার্যত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব শ্রমবাজারে নিম্নআয়ের মানুষকে পিছিয়ে রাখছে; তারা সর্বনিম্ন মজুরি ও সীমিত সুযোগে আটকে রয়েছে। ফলে বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই অনুমোদিত ও রক্ষিত হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা বৈষম্যকে আরও স্থায়ী করছে। সংসদ, স্থানীয় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যকর হওয়ার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় জবাবদিহির ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির ফলে বৃহৎ সরকারি চুক্তি, অবকাঠামো প্রকল্প, ব্যাংকঋণ ও ব্যবসায়িক লাইসেন্স বণ্টনে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতে বাজার প্রতিযোগিতা দুর্বল হচ্ছে, নতুন উদ্যোক্তাদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সম্পদ অল্প কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রের দলীয়করণ এবং নাগরিক সমাজের পরিসর সংকুচিত হওয়ায় বৈষম্যের রাজনৈতিক শিকড় আরও গভীর হয়েছে। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা কমে যাওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের অধিকার দাবি করার সংগঠিত প্ল্যাটফর্মও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সমানভাবে জরুরি। কর ব্যবস্থায় প্রগতিশীল সংস্কার করতে হবে অর্থাৎ আয়কর, সম্পত্তি কর ও উত্তরাধিকার করের আওতা বাড়িয়ে পরোক্ষ করের চাপ কমাতে হবে এবং কর ফাঁকি রোধে ডিজিটাল ট্র্যাকিং নিশ্চিত করতে হবে। রাজস্বনীতি এমন হতে হবে, যাতে সুবিধা পায় বৃহৎ জনগোষ্ঠী; ধনিক শ্রেণি নয়। একইসঙ্গে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বচ্ছ ও সর্বজনীন করা প্রয়োজন। উপকারভোগী নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি ও দলীয় প্রভাব বন্ধ করতে হবে এবং ডিজিটাল তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে যাতে দুর্নীতি ও অপব্যবহার কমে।
সাম্প্রতিক এক দশকে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ও দুর্নীতির বিস্তার বৈষম্যকে শুধু ত্বরান্বিত করেনি বরং তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ উদ্যোক্তারা সরকারি চুক্তি, ব্যাংকঋণ, করছাড় এবং বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বরাদ্দ পেয়েছেন; অথচ উদ্যমী নতুন উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এভাবে বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয় অধিক ক্ষমতাধর শ্রেণির জন্য পুঁজি সুরক্ষা ও সম্পদ বৃদ্ধির নিশ্চয়তায় পরিণত হয়েছে; আর সাধারণ মানুষের জন্য হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ সংকট ও খরচের বোঝা।
তাই দুর্নীতিকে কেবল নৈতিক সমস্যা নয়, বৈষম্যের কাঠামোগত চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আর্থিক তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে। একইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে, যাতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
সবশেষে, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিনিধিত্বই বৈষম্য কমানোর মূল শর্তগুলোর একটি। নীতিনির্ধারণে নাগরিক সমাজ, তরুণ, নারী ও শ্রমজীবী মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে যাতে ক্ষমতার কেন্দ্র অল্প কয়েকজনের হাতে না থেকে জনগণের কাছে ফিরে আসে।
রাকিব হোসেন : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী