এটা খুব আশাপ্রদ ব্যাপার যে, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠা শুরু হয়েছে জোরেশোরে, যা মাত্র কয়েক বছর আগেও প্রায় অসম্ভব ছিল। যৌন হয়রানি হওয়া মানেই ছিল নারী সেটি চুপচাপ সহ্য করে যাবে, কাউকে বলবে না, গোপন রাখবে এবং কোনোভাবে যদি ঘটনা জানাজানি হয় তবে পুরো পরিবার ও সমাজ মেয়েটিকেই দোষ দেবে। ‘তোমার সাথেই কেন এসব হয়? তোমারেই কেন বলে? তোমারেই কেন করে?’- ঠিক এমন।

যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বারবার আওয়াজ তোলা নারীবাদী মুভমেন্ট ও মেয়েদের ভেতরে তৈরি হওয়া সচেতনতা সমাজের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ফলে এখন যৌন হয়রানি করে সহজে অনেকেই পার পায় না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বিষয়টি শুধু লেখালেখি, সভা সেমিনার, মানববন্ধনে আটকে নেই। আশার কথা হলো, এখন গণমাধ্যমও এ নিয়ে সচেতন হতে শুরু করেছে। সংবাদ, টক শো নয় শুধু; নাটক, চলচ্চিত্রের মতো জনসংশ্লিষ্ট মিডিয়াতেও যৌন নিপীড়নের বিষয়টি আসতে শুরু করেছে। নারী অধিকারের পক্ষে ও পুরুষতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছেন আমাদের চলচ্চিত্র পরিচালকরাও।

রেহানা মরিয়ম নূর এ যাবৎকালের সবচেয়ে ধারালো, যুগোপযোগী সংযোজন, যা নারীর প্রতি সহিংসতা ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, প্রতিবাদের কণ্ঠটিকে আরও স্পষ্ট জোরালো ভঙ্গিতে দর্শকের কাছে তুলে ধরতে যাচ্ছে।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সিনেমা, ওয়েব সিরিজ তৈরি হয়েছে, যেখানে নারীর মধ্যযুগীয় দ্বিতীয় লিঙ্গের ধারণাটি ভেঙে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য অবসানের পক্ষে জোরালো বক্তব্য ছিল। রেহানা মরিয়ম নূর সেই ধারাবাহিকতায় এ যাবৎকালের সবচেয়ে ধারালো, যুগোপযোগী সংযোজন, যা নারীর প্রতি সহিংসতা ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, প্রতিবাদের কণ্ঠটিকে আরও স্পষ্ট জোরালো ভঙ্গিতে দর্শকের কাছে তুলে ধরতে যাচ্ছে। সিনেমাটির ট্রেইলার দেখে তাই মনে হলো। সিনেমাটি এখনো দেশে মুক্তি পায়নি। মুক্তি পেলে দেখার সুযোগ হবে আশা করি, তখন একজন দর্শক হিসেবে আমার প্রত্যাশাটুকু মিলিয়ে নিতে পারবো।

রেহানা মরিয়ম নূর কান ফেস্টিভ্যালে অভিনন্দিত ও প্রশংসিত হচ্ছে। আমরা আশা করছি, হয়তো পুরস্কারের একটি গর্বিত পালকও যুক্ত হবে এই সিনেমাটির অভিযাত্রায়। সে হোক বা না হোক, রেহানা মরিয়ম নূর এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সিনেমা অঙ্গনে যে বার্তাটি দিয়ে দিতে পেরেছে সেটি হলো, গুণী চলচ্চিত্রকার আমাদের আছেন, ভালো সিনেমা আমরা বানাতে পারি এবং সেই সিনেমা সমতা ও বৈষম্যহীন একটি পৃথিবীর কথা বলতে চায়, আমাদের নির্মাতারা সব শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গের মানুষের পক্ষে কথা বলার মতো সাহস ও যোগ্যতা রাখেন।

রেহানা মরিয়ম নূরের জন্য শুভকামনা। এবার একটু অভিনেত্রী বাঁধন প্রসঙ্গে আসি। সিনেমাটির প্রধান চরিত্র বা নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। কানে সিনেমাটির যাত্রা শুরুর পর থেকেই আমরা বাঁধনকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। এটিই আমাদের সমাজের বৈশিষ্ট্য। একজন প্রকৃত গুণী মানুষকে আমরা সহজে পথ তৈরি করে দিই না, সুযোগ দিতে চাই না, কিন্তু যখনই সে নানা কাঠখড় পুড়িয়ে, দুঃখ বেদনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, পরিশ্রম করে সফলতার দেখা পান, তখনই আমরা তাকে মাথায় তুলে নিই। সেটিও অবশ্য মন্দের ভাল। অন্তত উৎসাহ দিতে তো শিখেছি আমরা! আর বাঁধন তো বন্ধু হিসেবে, প্রকৃত সমঝদার হিসেবেও পেয়েছেন কিছু মানুষকে, যারা তার দীর্ঘ সংগ্রামী পথে পাশে থেকেছেন, কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, সমর্থন দিয়ে গেছেন।

বাঁধনের ব্যক্তিগত যুদ্ধের জায়গাটিও সাহস আর সপ্রতিভতায় উজ্জ্বল। পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের সমস্ত অনৈতিক নিয়ম আর আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এই বাঁধনই। দীর্ঘ লড়াই শেষে আদায় করে নিয়েছিলেন নিজের গর্ভের সন্তানের অভিভাবকত্ব। শুধু তাই নয়, নিজেকে গড়েছেন, তৈরি হয়েছেন, এরপর কাজে নেমেছেন।

নিজের শরীর আর মুখশ্রীর যত্নই শুধু নেননি, নিজের মন মানসিকতা ও চেতনার জায়গাটিকেও সমৃদ্ধ করেছেন, চিন্তাগুলোকে পরিষ্কার করে সাজিয়ে নিতে শিখেছেন, স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ় উচ্চারণে সেই চিন্তা ও চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেও পিছু হটেননি, সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিজের রুখে দাঁড়ানো শব্দগুলো। বাঁধনের এই সাহস মিডিয়া জগতে বিরল প্রায়। যেখানে অন্য বেশিরভাগ অভিনেত্রী বিয়ের পরেই অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন, স্বামীর মন জোগাতে নিজের আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাসের শেষ বিন্দুটুকুও বিসর্জন দেন, সবাইকে খুশি করতে হিজাব বোরখা ধরেন, সেইখানে বাঁধনের ভনিতাহীন স্পষ্ট কথা, প্রকাশ ও উপস্থিতি ভীষণরকম সাহসী, দুর্লভ এবং অবশ্যই অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

কান ফেস্টিভ্যালে অভিনন্দিত হওয়ার পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঁধনের প্রতিটি ছবির নিচে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে লোকে, নানা পোস্টে তার সম্পর্কে কুৎসা রটনা চলছে, এসব আমাদের কাছে নতুন নয়; এই সমাজের এসব নষ্ট সংস্কৃতি আমাদের সইতে হয়।

বাঁধনের সৌন্দর্য এ কারণেই এতোটা দ্যুতি ছড়াচ্ছে, কারণ সেই সৌন্দর্যে যুক্ত হয়েছে তার দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয়, সুউচ্চ মেরুদণ্ড এবং সুশিক্ষিত মনন। সুন্দর ফিগার, মুখশ্রী, দারুণ আউটফিট, মেকাপ, ঝলমলে হাসিতেও এই বাঁধনকেই আমাদের এতোটা অপূর্ব লাগতো না যদি না আত্মপ্রত্যয় আর দুর্দান্ত ব্যক্তিত্বের মিশেল না ঘটতো। তখন তিনি আর দশজন নায়িকার মতোই গড়পড়তা একজন হতেন, বাড়তি কোনো উন্মাদনা, আলোচনার সুযোগ থাকতো না।
যে কথা বলছিলাম। বাঁধন যখন নিজেকে গড়ছেন, তখন পাশে তার হাতে গোনা কিছু বন্ধু। আর বলা যায় পুরো সমাজটাই বরাবরের মতো তার বিরুদ্ধে।

বাঁধনের ব্যক্তিগত জীবনের লড়াই সেই বিরোধিতার মোক্ষম উদাহরণ। এখনও চোখে ভাসে আদালত প্রাঙ্গণে একজন লড়াকু মায়ের অশ্রু টলমল মুখ। অভিভাবকত্ব আদায়ের যুদ্ধ। অন্যদিকে ডিভোর্স নেওয়ার পর পুরো সমাজের হামলে পড়া। সাইবার জগতে অশ্লীল সব মন্তব্য, জাজমেন্টাল কথাবার্তা। এমনকি কান ফেস্টিভ্যালে অভিনন্দিত হওয়ার পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঁধনের প্রতিটি ছবির নিচে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে লোকে, নানা পোস্টে তার সম্পর্কে কুৎসা রটনা চলছে, এসব আমাদের কাছে নতুন নয়; এই সমাজের এসব নষ্ট সংস্কৃতি আমাদের সইতে হয়।

প্রায় প্রতিটি অভিনেত্রী, শিল্পী, তারকা, এমনকি লেখকরাও এসব সহ্য করেন দিনের পর দিন। এর প্রতিকার কোথায়? রাষ্ট্রের হাতে? আইনের দ্বারা? হয়তো সেটিই একমাত্র পথ। কিন্তু আমরা তো সেই আইনকে নড়তে চড়তে দেখি না এসব ক্ষেত্রে। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে নির্বিকার! তাই দিনের পর দিন বেড়ে চলে অসভ্যতা, সাইবার জগৎ হয়ে ওঠে অসভ্য রুচির কিছু লোকের অভয়ারণ্য। তো এ সবই তো বাঁধনকে সইতে হচ্ছে। কিন্তু এইসব কারণে তিনি নিজেকে দুর্বল, অসহায় হতে তো দেননি, উল্টো আরও শক্তিময়ী হয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। সমাজের হাজারো নির্যাতিত, বঞ্চিত মেয়ের চোখের সামনে বাঁধনের ফিরে আসা এক অবিস্মরণীয় অনুপ্রেরণাদায়ক উদাহরণ।

গ্ল্যামার নয়, বাঁধনের অস্ত্র ভালো অভিনয়। হ্যাঁ, গ্ল্যামারেও তিনি অনন্য। কিন্তু বাঁধনের নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতি, লাইভে তার মেকাপ বিহীন মুখ, সুন্দর বাচনভঙ্গিতে বলা কথাগুলোতে বারবার প্রকাশ পায় যে, বাঁধন গ্ল্যামার নয়, ছুটছেন ভালো কাজের পেছনে। তার মেদহীন শরীর সুন্দর স্বাস্থ্যের আত্মবিশ্বাস আনে, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদের বেঁধে দেওয়া ছকের ‘গ্ল্যামার’ নিয়ে তিনি ততোটা চিন্তিত নন বলেই আমার মনে হয়। তবু পর্দায় বাঁধনকে আমরা নানা চরিত্রে দেখতে চাই। তাই নিজেকে ঠিক যেভাবে রাখলে তা ভালো হয়, সেটিই তিনি বেছে নেবেন, এটা জানি। একই সাথে লড়বেন পুরুষতন্ত্রের অসভ্য, অভব্য আচরণের বিরুদ্ধে, কথা বলবেন লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আর একের পর এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবেন সমাজের সামনে।

শারমিন শামস্ ।। সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর