দেশে একেকটি আলোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আর আমরা তার প্রতিবাদ করি, মানববন্ধন করি, গণমাধ্যম তৎপর হয় লেখা কিংবা টকশো আয়োজনে। এরপর আবার আরেকটি ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কার্যকর কিছু হয় না। পরীমণি নামে বাংলাদেশে একজন অভিনয়শিল্পী আছেন। তিনি ঢাকার আশুলিয়ার একটি ক্লাবে গিয়ে শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

এখানে ইচ্ছে করেই ‘যৌন হয়রানি’ শব্দদ্বয় লেখা হচ্ছে না, কারণ একজন মানুষকে তিনি নারী হন কি পুরুষ হন, তাকে অপর কেউ আক্রমণ করলে পুরুষের ক্ষেত্রে যদি কেবল ‘শারীরিক আঘাত’ হিসেবে বর্ণিত হয় তাহলে কেবল নারীর ক্ষেত্রে ‘যৌন আক্রমণ’ বলে তার তীব্রতা বোঝাতে বিষয়টি সেখানেই ভিন্নরূপ লাভ করে।

পরীমণি বিষয়ক প্রকাশিত যেকোনো সংবাদের নিচে গিয়ে দেখুন, দেখবেন একপাল মানুষ হামলে পড়ছে এই অজুহাত নিয়ে যে, পরীমণি গেলেন কেন?

এজন্য একজন মানুষের উপর তিনি নারী কিংবা পুরুষ যেই-ই হোন, তার উপর আক্রমণ হওয়া মানেই একে শারীরিক আক্রমণ, হত্যা চেষ্টা হিসেবে দেখতে হবে, আলাদা করে ‘যৌন হয়রানি’ বা আক্রমণ হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে অহেতুক আইনি জটিলতা তৈরি করে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা আর আদালতে উকিলদের ‘কাপড় কোথায় ছিল?’, ‘এতরাতে আপনি ওখানে কী করছিলেন?’, ‘আপনার ঊরুতে আঘাত লেগেছে নাকি জঙ্ঘায়?’-ধরনের প্রশ্নবাণের সুযোগ করে দিয়ে ভুক্তভোগীকে পুনরায় চরম নোংরা ও ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার তো কোনো অর্থ হতে পারে না, তাই না?

পরীমণি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অভিনয়শিল্পী, তার ভক্ত সংখ্যা অগণিত এবং ইন্ডাস্ট্রিতে তাকে ঘিরেও রয়েছে বড় ধরনের বিনিয়োগ। কিন্তু তিনিও রাত ১২টায় ভদ্রলোকদের কোনো ক্লাবে যেতে পারবেন না, গেলে সেখানে তাকে ভদ্র ক্লাবের সদস্যদের কয়েকজন মিলে উত্যক্ত করতে পারে, মারধোর করতে পারে এবং তার ধর্ষণের (আবারও বলছি, এই শব্দটির বদলে লিখতে চাই শারীরিক আক্রমণ এবং যে আক্রমণটা সাধারণত শরীরের যৌনাঙ্গে করা হয়ে থাকে) শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যবিত্তের পথে হেঁটে যাওয়া দেশটির একজন নাগরিক (এবং তিনি নারী) রাত ১২টার পরে ঘরের বাইরে গেলে এমনকি তাকে ধর্ষণের পর হত্যার শিকারও হওয়া লাগতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই এই অবস্থাটিকে আর সভ্য বলতে পারি না।

চারদিন বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের মানুষের দ্বারস্থ হওয়ার পর তিনি যখন তার ফেসবুক পাতায় স্ট্যাটাস দিলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখলেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে মিডিয়া ডেকে পুরো ঘটনার বিবরণ দিলেন, তারপর দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নড়ে চড়ে বসতে দেখা গেল।  সুখের কথা হলো, অভিযোগকৃত ব্যক্তিদের বেশিভাগকেই ১৪ জুন গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুরো ঘটনা এতদূর আসার কথা ছিল না, তবু এল। কেন এল? সেই আগের কথায় ফিরে যাই আমরা, কারণ, প্রথমে বনানী থানায় মামলা নেয়নি, বলা হয়েছে ওসি নেই, কাল আসুন, তারপর পরীমণি এখানে-সেখানে, একে-তাকে ধরেছেন বলেই তার বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি এবং তিনি পরামর্শ পেয়েছেন যে, নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্যই যেন তিনি ঘটনাটি নিয়ে উচ্চবাচ্য না করেন কিংবা চেপে যান। কেন চেপে যাবেন? কারণ, তিনি একজন নারী এবং এ সমাজে নারীকে শারীরিকভাবে আঘাত করলেও সম্মান যায় নারীর। এটা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা তো বটেই, আলোকিত বলে খ্যাতিমান মানুষও এটাই মনে করেন।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যবিত্তের পথে হেঁটে যাওয়া দেশটির একজন নাগরিক (এবং তিনি নারী) রাত ১২টার পরে ঘরের বাইরে গেলে এমনকি তাকে ধর্ষণের পর হত্যার শিকারও হওয়া লাগতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই এই অবস্থাটিকে আর সভ্য বলতে পারি না।

পরীমণি বিষয়ক প্রকাশিত যেকোনো সংবাদের নিচে গিয়ে দেখুন, দেখবেন একপাল মানুষ হামলে পড়ছে এই অজুহাত নিয়ে যে, পরীমণি গেলেন কেন? চলচ্চিত্রের মেয়ে হয়ে তার এরকম ‘সতীপনা’ ঠিক মানাচ্ছে না। একে কী বলবেন? নিঃসন্দেহে ‘কালেক্টিভ ম্যাডনেস’ এবং আলোক প্রাপ্তরাও মনে করেন যে, এটা কেবল সমাজের উঁচুতলার অর্থবৃত্তওয়ালাদের নোংরা মানসিকতা, সমাজের সকল তল এই পুরুষতান্ত্রিকতা ধারণ করে না। বিনয়ের সঙ্গে অবশ্যই এ বিষয়ে দ্বিমত করছি।

কেন পরীমণির সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন? কারণ পরীমণি বিখ্যাত হয়েও এরকম একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এবং সেজন্য তিনি গণমানুষের দরবারে বিচার প্রার্থনা করেছেন।

রাষ্ট্র সেটি আমলে নিয়ে অভিযোগকৃত ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করেছে। এতে সমাজের সাধারণ ‘পারুল-চম্পা-মোমেনারা’ সাহসী হবেন এবং তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া (বা ঘটতে পারা) অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন। পরীমণি তাদেরকে পথ দেখালেন।

অপরদিকে, ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সমাজে সেরকম কুৎসিত মন ও ক্ষমতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো পুরুষদেরকেও রাষ্ট্র এর মাধ্যমে সতর্কবার্তা দিতে পারবে যে, তুমি যে ‘চান্দু’-ই হও না কেন, আইন তোমার পেছনেই আছে, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তোমাকে গ্রেফতার করা হবে। কোনো ক্ষমতাবান ‘বন্ধুর’(?) নাম করেও তুমি বাঁচতে পারবে না।

এক পরীমণিকে ন্যায় দেওয়া হলে বাঁচানো যাবে হাজারো পারুল/মোমেনাদের, দমানো যাবে হাজারো নাসির/মামুনদের। সে কারণেই, এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়াটা আবশ্যক।

মাসুদা ভাট্টি ।। এডিটর-ইন-চার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি