করোনা মানুষকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করছে দুই বছর ধরে। ক্ষুদ্র এ ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বারবার হানা দিচ্ছে করোনাভাইরাস নানা বেশে, নানা রূপে। এটি মানুষ না প্রকৃতির সৃষ্ট তা নিয়ে এখনো বিতর্কের অবসান হয়নি। তবে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিকতাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে এ ভাইরাসের কারণে। সারা দুনিয়া একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যার ফলে মহামারির প্রভাব কম বেশি সব দেশেই প্রতীয়মান। সবাই নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। ব্যক্তি স্বার্থের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সমষ্টিগত স্বার্থ।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার অন্তরালে বিশ্ব জুড়ে ব্যবসায়িক মনোভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান। বিশেষ করে চিকিৎসা খাতে। এর পাশাপাশি করোনার বিস্তার বৃদ্ধি পেলেই লকডাউন হয় যখন তখন। আর এতে করে মানুষের জীবন-জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এ অবস্থায় তাদের জনগণকে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে  আর্থিক সহায়তা দিয়ে। সেখানে প্রতিটি নাগরিক তার অবস্থা অনুযায়ী সরকারি সহযোগিতা পেয়ে আসছে নিশ্চিতভাবে। তাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের অবকাশ নেই। কারণ দেশের নাগরিকদের সব ধরনের তথ্য উপাত্ত প্রশাসনিকভাবে সংগৃহীত থাকে সরকারের নিদিষ্ট সংস্থার কাছে। সে তথ্য উপাত্ত নিয়ে সরকার ও জনগণের দায়বদ্ধতার স্থানটি অত্যন্ত স্বচ্ছ।

বাংলাদেশের লকডাউন গরিবের জন্য আতঙ্ক। কারণ দৈনিক আয় করা মানুষের কাছে ঘরে বসে অন্ন জোগাড়ের ব্যবস্থা নেই।

প্রত্যেকে তার সামাজিক ও আর্থিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান সরকারকে জানাতে বাধ্য। কারণ এটি নাগরিকের দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালন করে বলেই উন্নত দেশগুলো জনগণকে সুযোগ-সুবিধা যে কেবলমাত্র দুর্যোগ বা মহামারিকালে দিয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। বরং সারা বছর জুড়ে বেকার ভাতা, স্বাস্থ্য সেবা, সন্তানদের ভাতাসহ নানা সেবা দিয়ে থাকে জনগণকে। তাই করোনাকালীন সময়ে উন্নত বিশ্বের ঘরবন্দী মানুষকে আমাদের মতো লকডাউন উপেক্ষা করে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামতে হয়নি।

বাংলাদেশের লকডাউন গরিবের জন্য আতঙ্ক। কারণ দৈনিক আয় করা মানুষের কাছে ঘরে বসে অন্ন জোগাড়ের ব্যবস্থা নেই। গত বছরের লকডাউনে খাদ্য সামগ্রীর সাহায্য সহযোগিতা সরকারি বেসরকারিভাবে যতটা চালু ছিল এইবার সে পর্যায়ে নেই। তাই দেখা যায় দিনমজুর, গণপরিবহন খাতের কর্মজীবী মানুষদের দুঃখকষ্ট সীমাহীন। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে অনেক সিএনজি  চালক রিকশা চালিয়েছে। কারণ তার কাছে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য সংগ্রহ করা দুরূহ ব্যাপার।

গত ১৩ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন। সে প্যাকেজের আওতায় ৩৩৩  ফোন নম্বরে জনসাধারণের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এ টাকার খাদ্য সহায়তা সকল নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছালে হয়তো, অভাবী মানুষ জীবনের চেয়ে জীবিকাকে বেশি প্রাধান্য দিত না। লকডাউন মেনে ঘরে থাকত।

করোনা পৃথিবী থেকে সহজে বিদায় নেবে না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। গত বছর সরকার এলাকায় এলাকায় গরিব নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা তৈরি করেছিল। যদিও বা সে তালিকায় দলীয় নেতাকর্মীদের আত্মীয় পরিজন, চেনা জানা লোকের নামই বেশি ছিল। তারা গরিব বা নিম্ন আয়ের ব্যক্তি কি না তা যাচাই করার কোনো পদ্ধতি ছিল না। তাই দেখা গেছে সত্যিকারের গরিব মানুষের কাছে পৌঁছেনি সরকারের সাহায্য বা নগদ অর্থ।

গত বছর সরকার থেকে সহায়তা প্রদানের তালিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জাতীয় পরিচয় পত্রের ঠিকানা ও বর্তমানে বসবাসরত এলাকা এক না হওয়ার কারণে শহরের দিনমজুর ও বস্তিবাসীদের অনেকেই তালিকাভুক্ত হতে পারেনি।

এবারও লকডাউনের আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তিনি  পেশাভিত্তিক শ্রেণি বিভাজনের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বমোট  ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন। তন্মধ্যে প্যাকেজের অর্থ গরিব বা নিম্ন আয়ের মানুষ পাবে কি না সে প্রশ্ন উঠে। এ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৭০ জন মানুষকে নগদ ২ হাজার ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। যার মধ্যে ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩৮৯ জন দিনমজুর। আর বাকিরা হলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও নৌ শ্রমিক।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ হলো ভাসমান। গত বছর সরকার থেকে সহায়তা প্রদানের তালিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জাতীয় পরিচয় পত্রের ঠিকানা ও বর্তমানে বসবাসরত এলাকা এক না হওয়ার কারণে শহরের দিনমজুর ও বস্তিবাসীদের অনেকেই তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। এছাড়া এ কার্যক্রমের জন্য দল থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিম্ন আয়ের মানুষদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে বিবেচনা করে তালিকাভুক্ত করেছে। এসব কারণে সত্যিকারের অভাবী মানুষ সরকারের সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। তবে এ ধরনের জটিলতা হতো না যদি সরকারিভাবে অন্যান্য দেশের মতো এদেশের জনগণের আর্থিক অবস্থার তথ্য উপাত্ত থাকত।

সরকার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যদিও বর্তমান সময়ে সরকারের ত্রাণ সাহায্য সহযোগিতার দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ কম। তথাপি সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন আয়ের মানুষদের ন্যায্য পাওনা নিয়ে তথৈবচ অবস্থা দেখলে মনে হয়, ‘গরিব গরিবই রয়ে যায় সর্বকালে। আর তাদের অর্থ দিয়ে আয়েশ করে সমাজের অর্থলোভী দুর্নীতিবাজরা।’

এ করোনার মহামারিতে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে। কিন্তু সমাজের এক শ্রেণি আরও বেশি বিত্তবান হয়ে উঠছে তাদের ব্যবসায়িক মুনাফালোভী মানসিকতা নিয়ে। ঈদের পর আবার লকডাউন আসছে। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা বেশ কষ্টকর। ব্যবসা চলমান না থাকলে তাদের জন্য ঋণের কিস্তি অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোর ঋণের চাপে অনেক দরিদ্র মানুষের ভিটে মাটি হারানোর ঘটনা নতুন নয় এদেশে। তাই এবারের প্রণোদনা প্যাকেজে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়া বা নেওয়া সহজ নয় এ মুহূর্তে।

প্রকৃতপক্ষে সরকার গরিব মানুষদের মুখে হাসি ধরে রাখতে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিলেও তার শতভাগ সুফল তারা পায় না। কারণ প্রশাসনিকভাবে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া তাদের অর্থ তারা পাওয়ার সিস্টেম দেশে গড়ে ওঠেনি। তাই নিম্ন আয়ের দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, ড্রাইভার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। সেজন্য মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে ‘করোনা বলে কিছু নাই’ বলে তারা নিজেদের কাজ দিয়ে চলতে চায়। কারণ বস্তির দিনমজুর বা অন্যের বাড়িতে খেটে খাওয়া গৃহকর্মীর গরিব জীবনে সরকারের বিরাট অংকের প্রণোদনা প্যাকেজের খবর আর তার হিসাব নিকেশ বড় জটিল।

হাসিনা আকতার নিগার ।। কলামিস্ট