জেন্ডার শব্দটি বাংলা ভাষায় এখন আর নতুন শব্দ নয়। কারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তাত্ত্বিক ধারণার পাঠদান শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ সালে ‘উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ’ স্থাপিত হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আধিপত্য থেকে সমাজকে সমতার অবস্থানে বিন্যস্ত করার জন্য জেন্ডার ধারণার তাত্ত্বিক পাঠদান সূচিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বিষয়টিকে সংযুক্ত করার কারণে বিশ্বজুড়ে জেন্ডার ধারণা বিস্তৃত পরিসর অর্জন করেছে।

সেক্স, নারী-পুরুষের শারীরিক অবয়ব নির্ধারণ করে। সেজন্য বলা হয় মেল সেক্স, ফিমেল সেক্স। কিন্তু জেন্ডার নির্ধারণ করে নারী- পুরুষের সমতাভিত্তিক সামাজিক অবস্থান। প্রাকৃতিকভাবে নারী-পুরুষের শারীরিক পার্থক্য জৈবিক। এই পার্থক্য মানব সভ্যতার দুটি ধারার বৈশিষ্ট্য। এর কোনো পরিবর্তন হয় না। কিন্তু সামাজিকভাবে নারী-পুরুষের পার্থক্য সমজীবনের লক্ষ্যকে বিপর্যস্ত করে।

বাঙালির সভ্যতায় হাজার বছরের ইতিহাসে নারীর বঞ্চনার জায়গা যেমন আছে, তেমন আছে নারীকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। এখন থেকে দুইশ বছরের বেশি সময় আগে মেয়েদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা ছিল সামাজিক রীতি। এর পক্ষে-বিপক্ষে সে সময় নানা বিতর্ক হয়েছিল।

স্মরণ করি একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ।

পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার লিখেছিলেন, ‘বিশ্বপিতা স্ত্রী ও পুরুষের কেবল আকারগত কিঞ্চিৎ ভেদ সংস্থাপন করিয়াছেন মাত্র। মানসিক শক্তি বিষয়ে কিছুই ন্যূনতম আধিক্য স্থাপন করেন নাই। অতএব বালকেরা যেরূপ শিখিতে পারে, বালিকারা সেরূপ কেন না পারিবে।’

বাউল কবি লালন শাহ বলেছেন, ‘বামন চিনি পৈতা প্রমাণ, বামনী চিনি কি সে রে?’ ধর্মে পুরুষের আধিপত্যকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। এসব লেখা থেকে বোঝা যায় সমাজের মুক্ত চিন্তার মানুষেরা নারীকে অবদমনের জায়গাকে সঠিক চেতনায় চিহ্নিত করেছিলেন। সমাজে সমতার জায়গা তৈরিতে নিজেদের ভূমিকা স্পষ্ট রেখেছিলেন।

১৮৭৩ সালে কলকাতায় বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পর্যন্ত মঞ্চে নারী চরিত্রে পুরুষরা অভিনয় করত। থিয়েটার মালিকদের কেউ কেউ মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাটক মঞ্চস্থ করতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার নাটকে মেয়ে চরিত্রের অভিনয় মেয়েরা করবে। নইলে আমার নাটক মঞ্চস্থ করতে দেব না।’ এই প্রতিবাদের সামনে থিয়েটারের মালিকরা মঞ্চে মেয়েদেরকে মেয়েদের স্থান ছেড়ে দেয়। জেন্ডার তাত্ত্বিক ধারণার বাইরে সমাজ-প্রগতিতে এভাবে নারীর ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নারীকে দমিয়ে রাখার শেষ রক্ষা তারা করতে পারেনি।

আমরা স্মরণ করি, মুসলিম মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের স্কুলে এনে রক্ষণশীল গণ্ডি ভেঙ্গেছিলেন। সমাজকে জেন্ডার সমতার মুখোমুখি করেছিলেন। এভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নারী তার জ্ঞান দিয়ে পরিচর্যা করেছে সমাজকে। এগিয়েছে সমাজের স্রোত। আজকে এই ধারাবাহিকতায় স্মরণ করি একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী।

ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ। ব্যক্তি জীবন থেকে রাজনৈতিক জ্ঞানের জায়গায় তিনি জেন্ডার সমতার বলয় তৈরি করেছিলেন স্বামী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে। দুজনের পরিশীলিত জীবনের নানা সূত্রে কোথাও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের জায়গা তৈরি হয়নি। বাংলার জনজীবনে এ এক দিগন্ত বিথারি উদ্ভাসন। জেন্ডার সমতার আলোয় ঝরেছে টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে অজস্র শিউলি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি রচনা করেন জেলখানায় রাজবন্দি থাকার সময়। তিনি এই বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে স্ত্রী ফজিলাতুননেছার কথা লিখেছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’

একই পৃষ্ঠার এই অংশ শেষ করেছেন এভাবে—‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’

জেন্ডার সমতার সূত্র থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এখানে পারিবারিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে দেশ- জাতির জন্য সময়ের ইতিহাস রচনা দুজনেই গভীরভাবে ভেবেছেন। রাজনীতির কারণে কারাবন্দি স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করেছেন সময়ের ছবি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখার জন্য। সম্পর্কের এই গভীর বোঝাপড়া জেন্ডার সমতার অনন্য উদাহরণ। এতে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের জ্ঞানযোগের বিষয়টি ফুটে ওঠে।

গ্রন্থের শেষে টিকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পাণ্ডুলিপির জন্য ব্যবহৃত খাতাগুলি ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স, ঢাকা ডিভিশন, সেন্ট্রাল জেল, ঢাকা, ৯ জুন ১৯৬৭ ও ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ তারিখে পরীক্ষা করেন। অপরদিকে লেখককে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ থেকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, লেখক তার এই আত্মজীবনীটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধে রচনা শুরু করেন।’

অন্যদিকে মনে হয় রেণুর তাগাদা ছাড়া এবং খাতাগুলো প্রদান করা ছাড়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি কি রচিত হতো? বঙ্গবন্ধু পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের চিন্তা থেকে রেণুকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। পারিবারিক জীবনের সমতা অনায়াস সত্যে তুলে ধরেছেন।

সাংবাদিক-লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক লেখা ‘স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু পত্নী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘৩২ নম্বরে এলে ভাবি প্রায়ই চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। তিনি জানতেন আমি পেটুক। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্য শুধু চা এলেও আমার জন্য সঙ্গে থাকতো তার হাতে বানানো মিষ্টি, বিস্কিট, কখনো একটু পুডিং বা এক টুকরো কেক। একদিন ৩২ নম্বরের এই লাইব্রেরি কক্ষে বসেই বঙ্গবন্ধু ভাবিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘একজন নারী ইচ্ছে করলে আমার জীবনটা পাল্টে দিতে পারতেন।’ আর জবাবে আমি বলেছিলাম, ‘তিনি যদি আপনার জীবন পাল্টে দিতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসও সেদিন পাল্টে যেত।’ আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিন যেমন শেখ মুজিবের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে, তেমনি হবে মুজিবের পত্নী বেগম ফজিলাতুননেছাও। তাকে ছাড়া বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস রবে অসম্পূর্ণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০/১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনোদিন মুখ কালা কিংবা আমার উপর প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে বোধহয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। অনেক সময় আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’

বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যে বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের কর্মযোগ আলোকিত হয়ে ওঠে।

রেণুর তাগাদা ছাড়া এবং খাতাগুলো প্রদান করা ছাড়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি কি রচিত হতো? বঙ্গবন্ধু পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের চিন্তা থেকে রেণুকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি।

পরিবারের আর একজন সদস্য ড. ওয়াজেদ মিয়া। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বামী। তার বইয়ের নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’।
অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়। পরিস্থিতি থমথমে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা চলছে। ড. ওয়াজেদ মিয়া ২৩ মার্চের দুপুরের কথা লিখেছেন, ‘ওইদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারো সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এতদিন ধরে যে আলাপ- আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো কিছু তো বলছো না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা করো, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধা মতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এদেশের জনগণও তোমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, আলোচনা এখনো চলছে, এই মুহূর্তে খুলে বলা সম্ভব না। এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপর তলায় চলে যান।’

আর একটি ঘটনা ৭ই মার্চের বিকেলের। সেদিন ৩২ নম্বর বাড়িতে নেতাকর্মীদের ভিড় ছিল। প্রত্যেকেই সেদিনের ভাষণে কী বলা হবে তার নানা মতামত দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু দোতলায় উঠে এলে রেণু বললেন, অনেকেতো অনেক কথা বলছেন। তুমি নিজে ঠিক কর তুমি কি বলবে। তোমার সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষ লাঠি-বৈঠা নিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাইফেলের নল তোমার সামনে। তোমার নিজেকে ভেবে কথা বলতে হবে। তুমি পনেরো মিনিট শুয়ে থেকে চিন্তা কর। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার আগে পনেরো মিনিট চুপচাপ শুয়েছিলেন। তারপর একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন, যেটি  ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিলে স্বীকৃত হয়েছে। অসাধারণ ভাষণটি বিশ্ব জয় করেছে।

এভাবে বিশ্লেষণ করে এগোলে আরও নানা প্রসঙ্গ সামনে আসবে। বঙ্গমাতার এই দূরদর্শী চেতনা বোধ সমাজ আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন পূরণ ঘটায়। এই প্রজন্ম তার কর্মযোগ থেকে চিন্তার আলো দেখে নেবে। জ্ঞানযোগ থেকে গবেষণার উপাদান পাবে। দেশ ও জাতির ক্রান্তি লগ্নে সঠিক পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা কীভাবে সাহসের সঙ্গে উপস্থাপন করতে হয় সেটাও শিখবে।

বঙ্গমাতার কর্মযোগ বড়ই উজ্জ্বল। তিনি আমাদের এই সময়ে খনা, এই সময়ের বেগম রোকেয়া, এই সময়ের চন্দ্রাবতী। তিনি ইতিহাসের মানুষ। তিনি জীবন বৈভবের দিশারি।

সেলিনা হোসেন ।। কথাসাহিত্যিক