ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে অসামান্য অবদানের জন্য যে নারীর ত্যাগ, অবদান ও প্রেরণার কাছে ঋণী, তিনি হলেন তারই স্ত্রী ফজিলাতুননেছা মুজিব।

বঙ্গবন্ধু তার জীবন ও যৌবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন জনগণের সেবায়, দেশের কল্যাণে। এই সময়কালে বেশিরভাগ সময়ই বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছে জেলে। আর সেই সময়গুলোতে কাণ্ডারির মতো হাল ধরেছিলেন বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব।

৮ আগস্ট এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এই দিনে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফুলের মতো গায়ের রং দেখে মা হোসনে আরা বেগম ডাকতেন রেণু বলে। সেই নামেই সবার কাছে তার পরিচিতি হয়ে গেল।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, পরম্পরায় বাংলাদেশ 

রেণুর বয়স যখন মাত্র তিন বছর, হঠাৎ করেই তার বাবা শেখ জহুরুল হক মারা গেলেন। তখন দাদা শেখ আবুল কাশেম রেণুর চাচাতো ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রেণুর বিয়ে দেন।

রেণুর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তার মা মারা গেলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের মা সায়েরা খাতুন রেণুর চোখের পানি মুছিয়ে কোলে তুলে নিলেন। গভীর মমতায় নিয়ে এলেন নিজের ঘরে। তারপর শেখ মুজিবের বয়স যখন কুড়ি বছর তখন তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়।

বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব একদিকে যেমন শক্ত হাতে সংসার ও সন্তানদের সামলেছেন, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করে স্বামীর সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো জুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা।

ঐ সময় মুসলিম মেয়েরা ঘরের বাইরে স্কুলে লেখাপড়া করত না বলে তিনি ঘরে বসে লেখাপড়া শিখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, তিনি ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিদীপ্ত, দায়িত্ববান ও ধৈর্যশীল। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তার প্রভাব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা থেকেই তা জানা যায়।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বাংলাদেশ 

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী লেখার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল বেগম ফজিলাতুননেছার। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

সে প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘...আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছিল। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১)

আরও পড়ুন : তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব একদিকে যেমন শক্ত হাতে সংসার ও সন্তানদের সামলেছেন, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করে স্বামীর সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে ছায়াসঙ্গীর মতো জুগিয়েছেন সাহস ও উদ্দীপনা।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে, সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। কারাবন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় বছর তাকে আটক করে রাখল। যেহেতু স্বামী কারাবন্দি, সেজন্য রেণুকে কেউ বাড়িভাড়া দিতে চাইতো না। তিন দিনের নোটিশে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার মনের জোর ছিল প্রবল।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

দুঃসময়েও সবদিক লক্ষ্য রেখে শান্ত মনে নিজেই সামলাতে পারতেন সবকিছু। ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু কষ্ট আর অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি সংসার চালিয়ে যেতে সমর্থ হন। নিজেই বাচ্চাদের কাপড় সেলাই করতেন। তাদের লেখাপড়ার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। পিতার অভাবটা নিজের স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতেন। আবার তাকে মামলার খোঁজখবর নিতে আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে।

স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনার প্রসঙ্গে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

কারাবন্দি স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে হয়েছে। স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু একটি ঘটনার প্রসঙ্গে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১২৬)

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে।

আরও পড়ুন : ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার

দীর্ঘ সময় পর ক্যান্টনমেন্টে বন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে ফজিলাতুননেছা মুজিবকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হতো। এ সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছাত্র নেতাদের কাছে পোঁছে দিতেন তিনি।

তারপর ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দি মুক্তি পান। পরের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাত্র-জনতা ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে সংবর্ধনা জানিয়ে বাঙালির একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে প্রেরণাদাত্রী হিসেবে ফজিলাতুননেছা মুজিবের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ঘটনাটি ছিল এ রকম—এই ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলবেন সে বিষয়ে অনেকে তাকে পরামর্শ, উপদেশ, চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফজিলাতুননেছা মুজিব তাকে সভায় যাওয়ার আগে ঘরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় একাকী থাকতে দেন।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

সে সময় তিনি তাকে বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, তোমার সামনে আছে জনতা এবং পেছনে বুলেট। তোমার মন যা চাইছে তুমি শুধু সেটাই আজ করবে।’ সেই শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি শেখ মুজিবের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচিত।

শেখ মুজিবের স্ত্রী ও সহযাত্রী হিসেবে বাংলার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা ছিল তারও লক্ষ্য। তাই ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব জনতাকে কি বলবেন, তা রেণুকেও আলোড়িত করেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ফজিলাতুননেছা মুজিবের দৃঢ়চেতা অথচ দরদি মন ছিল এবং ছিল আন্তরিক সহযোগিতা। বাঙালির অধিকার আদায় ছাড়া শেখ মুজিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতার কোনো আকর্ষণ ছিল না। ফজিলাতুননেছা মুজিবও সেই আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলেন। সন্তানদের তৈরি করেন।

বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বলেই বত্রিশ নম্বর বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কখনো থাকতে রাজি হননি। বাড়িতে কার্পেট, দামি আসবাবপত্র, এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করেননি।

আরও পড়ুন : অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ

নিজের হাতে স্বামীর প্রিয় খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতেন অথবা কখনো নিজে নিয়ে যেতেন। একজন আদর্শ নারীর প্রতীক যেন তিনি। তার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই একজন মমতাময়ী মায়ের প্রতিকৃতি।

শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের রেণু ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন। অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। এসব কাজ তিনি নিজ উদ্যোগে করতেন। কখনো সরকারিভাবে কিছু চাইতেন না। নিভৃতচারী, ত্যাগী এ নারীকে জনগণ ‘বঙ্গমাতা’ হিসেবে সম্মানিত করেছে।

বঙ্গবন্ধুর আজন্ম জীবনসঙ্গী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে মারা যান। এই মহীয়সী নারীর কথা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ফরিদুন্নাহার লাইলী ।। সাবেক সংসদ সদস্য এবং কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ