করোনা টিকা নিয়ে আমাদের দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই হচ্ছে; আশা ও নিরাশা এবং অর্জন ও বিসর্জন। করোনা টিকার প্রারম্ভটা ছিল আমাদের দারুণ; যখন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও টিকার জোগান করতে পারেনি, তখনই আমরা টিকার জন্য চুক্তি, অর্থ লগ্নি করা এবং টিকার প্রথম চালান পেয়ে টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন এবং সারাদেশ জুড়ে টিকা দেওয়া শুরু করে প্রায় হৈ চৈ ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছাই।

ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে চুক্তিকৃত টিকা এবং কোভ্যাক্স উদ্যোগের টিকার সমন্বয়ে প্রাধিকার তালিকা ধরে ক্রমান্বয়ে দেশের সকল নাগরিকদের টিকা দেওয়ার নীল নকশা বেশ পাকাপোক্ত প্রতিভাত হতে থাকে।

প্রথমে টিকাদানের দুটো বিষয় আমাদের কারও কারও কপালে ভাঁজ তোলে; অ্যাপস বা ওয়েব সাইটের মাধ্যমে নিবন্ধন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও গ্রামাঞ্চলে সুপরিচিত টিকা কর্মী স্বাস্থ্য সহকারীদের টিকাদানে যুক্ত না করা এবং সারা উপজেলায় একটি মাত্র টিকাদান কেন্দ্র থেকে টিকা দেওয়া।

বয়সসীমা ৫৫ বছর ঊর্ধ্ব থেকে নামিয়ে চল্লিশ বছর করায় আমাদের আপাত তৃপ্তি আসে যে, যথেষ্ট মানুষ টিকা নিচ্ছে। কিন্তু ৫৫ বছর ঊর্ধ্ব নিভৃত গ্রামীণ ও বস্তিবাসী যে টিকার সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হলো, তা আমাদের রোদ্দুর চশমায় ধরা পড়ল না।

গ্রামের বয়স্ক নিরক্ষর মানুষদের টিকা গ্রহণে এই তিনটি বিষয় টিকা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা হবে বলে আমাদের উদ্বেগ ছিল। এর সাথে একটি ভ্রান্ত ধারণা বেশ দানা পাকাতে শুরু করে যে, গ্রামের খেটে খাওয়া রোদ-বৃষ্টিস্নাত গরিব মানুষ, বস্তির মানুষদের করোনা হয় না। তার ফলে এবং শ্রেণি-ঘৃণার সমন্বয়ে প্রথম পর্যায়ের উদ্দিষ্ট ৫৫ বছর ঊর্ধ্ব গ্রামীণ ও বস্তিবাসী টিকা হতে দূরে থাকে। কিন্তু মূল সমস্যার সমাধান না করে, হঠাৎ করে বয়সসীমা ৫৫ বছর ঊর্ধ্ব থেকে নামিয়ে চল্লিশ বছর করায় আমাদের আপাত তৃপ্তি আসে যে, যথেষ্ট মানুষ টিকা নিচ্ছে। কিন্তু ৫৫ বছর ঊর্ধ্ব নিভৃত গ্রামীণ ও বস্তিবাসী যে টিকার সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হলো, তা আমাদের রোদ্দুর চশমায় ধরা পড়ল না।

এই জোশে, যখন হঠাৎ করে সেরাম ইন্সটিটিউটের চুক্তিকৃত চালান আসলো না এবং দ্বিতীয় ডোজ শুরু হলো, তখনো আমরা প্রথম ডোজ চালিয়ে যেতে থাকলাম। এর ফলে দুটো সমস্যা দেখা দিল—একটা হলো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর অরক্ষিত থাকা এবং আরেকটি হলো অর্ধকোটি মানুষের অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় আরাধ্য ডোজ না পাওয়ার হা-হুতাশ।

ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সুনামিতে গ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ টিকা অরক্ষিত মানুষ বেশুমার আক্রান্ত হতে থাকল; অনেকে জীবন দিয়ে প্রমাণ দিলেন যে, করোনাভাইরাসে রোদে পোড়া গরিব মানুষ টিকা বিহীন সুরক্ষিত নয় এবং আমাদের সৃষ্ট তিন প্রতিবন্ধকতা সঠিক ছিল না, আমরা জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে দোষী হয়ে গেলাম।

সেরাম ইন্সটিটিউটের চুক্তিবদ্ধ টিকা সরবরাহ না হওয়ার প্রেক্ষাপটে জেগে উঠল আমাদের বাঙালি সত্তা; রাশিয়া-চীন, প্রাচ্য-প্রতীচ্য জুড়ে আমাদের বিদেশ মন্ত্রক নিত্য নতুন আশার বাণী জানিয়েই খান্ত হলো না, সত্যি সত্যি টিকা আসতে লাগল।

উপঢৌকন, ক্রয় চুক্তি, উৎপাদন চুক্তি, কোভ্যাক্স উদ্যোগের টিকা, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীনের টিকা বাংলাদেশ ভাণ্ডারকে একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নিয়ে আসে।

ইতিমধ্যে কোটি কোটি মানুষ নিবন্ধিত হয়েছে। মাস দেড় মাসে টিকা না পেয়ে অনেকেরই মুখ বেজার, টিকা না পাওয়ার দোলাচলেও কেউ কেউ।

অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দ্বিতীয় ডোজ প্রত্যাশীদের হতাশাকে প্রাপ্তির অপার আনন্দে ভাসাতে পারল সমৃদ্ধ ভাণ্ডার নিয়ে। কর্তৃপক্ষ গণটিকার উৎসবে মাততে সচেষ্ট হলো। উৎসাহের আতিশয্যে বয়স কমিয়ে, ওয়েব সাইট ভিত্তিক নিবন্ধন পাস কাটিয়ে জাতীয় পরিচয় পত্র বা যেকোনো প্রত্যয়ন পত্র দিয়ে টিকা নিতে পারা, সেই অতি পরিচিত টিকা কর্মীদের যুক্ত করা, উপজেলার এক কেন্দ্র ধারণা থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক কেন্দ্রে টিকাদান, জনসম্পৃক্তকরণ কার্যক্রমে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সংগঠনের যুক্ততায় যে বিশাল চাহিদার সৃষ্টি হলো, তাতে প্রায় রণে ভঙ্গ দিয়ে প্রত্যাহার করতে হলো গণটিকাদান কার্যক্রম।

এখন চলছে প্রথম দিকের নিয়মিত টিকাদান কেন্দ্রের মাধ্যমে টিকাদান। ইতিমধ্যে কোটি কোটি মানুষ নিবন্ধিত হয়েছে। মাস দেড় মাসে টিকা না পেয়ে অনেকেরই মুখ বেজার, টিকা না পাওয়ার দোলাচলেও কেউ কেউ।

আসলে বাংলাদেশ টিকাদান কর্মসূচি বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত বারংবার পরীক্ষায় সফল একটি কার্যক্রম; বিশ্ব টিকার মুকুট বারেবারে ওঠে যে দেশের ললাটে, তাদের করোনা টিকাতে এমন খাবি খাওয়া মানায় না।

আমাদের জাতীয় পর্যায়ে আছে স্বাস্থ্য বিভাগের পোড় খাওয়া কিছু চৌকস কর্মকর্তা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ,  (দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স) গাভির কিছু চৌকস কর্মকর্তা, জাতীয় টিকা কারিগরি দল (নাইট্যাগ) এর বিশেষজ্ঞগণ এবং মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পরিচালক, সিভিল সার্জন, ইউএইচএফপিও এবং সর্বোপরি টিকা কর্মীগণ; তাদের সম্মলিত প্রয়াসে করোনায় টিকাদানেও বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য এনে দিতে পারা উচিত।

প্রয়োজন আমাদের করোনা টিকা বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক কর্মকৌশল অনুসরণ জরুরি। সেই কৌশলে ক-খ-গ পন্থা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা যেন আচমকা ভোল পাল্টিয়ে না ফেলি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হতে বিচ্যুত না হই।

কোনো ব্যক্তির ইচ্ছায় হঠাৎ করে কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন না করে, নির্দিষ্ট কমিটির সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুসারে পরিচালিত হয় করোনা টিকাদান। রোগতত্ত্ব, টিকা বিজ্ঞান ইত্যাদি যেন করোনা টিকাদানের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মানদণ্ড হয়।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক