বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও করোনার প্রভাবে বন্ধ আছে স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ বিরতিতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার অপূরণীয় ক্ষতি কমিয়ে আনতে দূরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থার বেশ কিছু আয়োজন করা হয়েছে। তবে, যে ব্যবস্থাটির দিকে সবাই এখন বেশি এগিয়ে যাচ্ছে, সেটি হলো অনলাইন ক্লাস।

বিশেষ করে, শহরকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই কার্যক্রম বেশ কিছুদিন ধরে চলে আসছে। কিন্তু, শিশুদের ক্ষেত্রে এই অনলাইন ক্লাস, আপাত সমাধানের পাশাপাশি বেশ কতগুলো চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। 

একদিকে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কিছু অংশ এই কার্যক্রমের অংশ হতে পারছে, অন্য অংশ একেবারেই বাইরে থেকে যাচ্ছে, জন্ম দিচ্ছে বৈষম্যের; অন্যদিকে, যারা অংশগ্রহণ করতে পারছে, তারাও সম্মুখীন হচ্ছে নানা ধরনের সমস্যার।

ইউনিসেফের করা ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, গড়ে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ শিশুর ইন্টারনেট ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আবার, করোনার এই সময়ে, বিভিন্ন কারণে শিশুদের উপর বেড়েছে মানসিক চাপও।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর, ২০২০ সালে করা এক জরিপে উঠে এসেছে, ৫ থেকে ১১ বছর বয়সীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা নেওয়ার হার বেড়ে গেছে শতকরা ২৪ ভাগ, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই হার শতকরা ৩১ ভাগ।

শিশুদের ক্ষেত্রে এই অনলাইন ক্লাস, আপাত সমাধানের পাশাপাশি বেশ কতগুলো চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। একদিকে, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কিছু অংশ এই কার্যক্রমের অংশ হতে পারছে, অন্য অংশ একেবারেই বাইরে থেকে যাচ্ছে, জন্ম দিচ্ছে বৈষম্যের...

আমাদের দেশের শিশুরা যে অনলাইন ক্লাসে অংশ গ্রহণ করছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সময়টাতে শিশুদেরকে যে শুধু তাদের পাঠ্যপুস্তকের পড়াই পড়তে হচ্ছে তা নয়, সাথে সাথে একদমই নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ডিজিটাল মাধ্যমগুলোর সাথে পরিচিত হতে হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে, অনেক শিশুর পরিবার থেকেও সহায়তা পাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না; কারণ, পরিবারের সদস্যদেরই হয়তো এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সাথে পরিচত হতে বেগ পেতে হচ্ছে। 

তাছাড়া, শিশুদের জন্য স্কুল শুধুমাত্র পড়াশোনার জায়গা নয়, স্কুলে গিয়েই শিশু প্রথম সুযোগ পায় সামাজিকভাবে অন্যদের সাথে মেশার, সমবয়সী সহপাঠীদের সাথে কথা বলার, খেলাধুলা করার। অনলাইন ক্লাস, শিশুর সেই চমৎকার পরিবেশ দিতে পারছে না বরং তার জন্য নিয়ে এসেছে বন্দিদশা।

দীর্ঘদিন বন্দি থাকার কারণে অবচেতন মনে শিশু যদি ভাবতে শুরু করে, সামনের দিকেও ক্লাস এভাবেই চলতে থাকবে, তাহলে তার শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও নিরানন্দময় হয়ে যেতে পারে।

এই চ্যালেঞ্জিং সময়টাতে শিশুদের পাশে থাকার জন্য, তাদেরকে সহায়তা করার জন্য, স্কুল তথা শিক্ষক, পরিবার-পরিজন এবং সরকার সকলের নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।

পিতা-মাতা বা পরিবারের সদস্যরা শিশুদের ইমোশনাল সাপোর্টটুকু দিতে পারেন, তাদের আবেগ-আচরণের দিকে খেয়াল রেখে সহানুভূতিশীল হতে পারেন, সম্ভব হলে তাদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারেন।

বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমস্যা হলে, সেগুলোর সমাধানের উপায় বের করার জন্য আন্তরিক হতে পারেন। ক্লাস চলাকালীন শিশুর মনোযোগের ঘাটতি হয়, এরকম কার্যকলাপ যথাসম্ভব সীমিত করতে পারেন।

দীর্ঘদিন বন্দি থাকার কারণে অবচেতন মনে শিশু যদি ভাবতে শুরু করে, সামনের দিকেও ক্লাস এভাবেই চলতে থাকবে, তাহলে তার শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও নিরানন্দময় হয়ে যেতে পারে।

শিক্ষকরা নিশ্চিত করতে পারেন শিশুদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে আলাদাভাবে নজর দিতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, ক্লাসে উৎসাহী করার জন্য শিক্ষকরাই সবচেয়ে বড় এবং কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্যদিকে, সরকার জরুরি ভিত্তিতে অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তৈরি করতে পারে কার্যকর নীতিমালা।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার শিশুদের লেখাপড়ার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা দেওয়ার অংশ হিসেবে, পিতা-মাতাকে কয়েক সপ্তাহের বেতন দিয়ে ছুটির অনুমোদনও করে দিয়েছে, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শের জন্য নিয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের পদক্ষেপ।

সর্বোপরি, শিশুদের সাথে কথা বলে তাদের মনোভাব জানতে চেষ্টা করা, কোন বিষয়টি তারা পছন্দ করছে, কোন বিষয়ে তাদের সমস্যা হচ্ছে, সেই অনুযায়ী অভিভাবক এবং শ্রেণি শিক্ষক সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণের প্রয়োজন আছে। শিশুদের অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে শিশুকে ক্লাস করতে অনুপ্রাণিত রাখতে পারার মাঝে। সেটি কার্যকর শিক্ষা প্রদানের জন্য যেমন জরুরি, ঠিক তেমন জরুরি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য।

করোনার এই কঠিন সময়টাতে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন পুরো শিক্ষাব্যবস্থা হয়েছে, শিশুরাও সেটির বাইরে থাকেনি। কিন্তু, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারাটাই টিকে থাকার মূলমন্ত্র।

আমরা সবাই আমাদের নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা নিজ থেকে বলতে পারলেও, নিজদের অধিকার নিজেরা আদায় করে নিতে পারলেও, শিশুরা পারে না; কারণ, তারা শিশু।

শিশুদের ভালো-মন্দের দিকটা দায়িত্বশীল অন্যদের ভাবতে হয়, শিশুদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অন্যদের। শিশুদের কথা, তাদের ভালো-মন্দ সময় ও গুরুত্ব দিয়ে না ভাবলে, তার দায়ভার এড়াতে পারবে না কেউই এবং তার ফল ভোগ করতে হবে পুরো জাতিকেই।

ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
bmmainul@du.ac.bd