ছবি : সংগৃহীত

বরিশাল, মুলাদী পাতারচর গ্রাম, জয়ন্তী নদীর একদম পাশ দিয়ে ফকিরবাড়ি রোডের লাল টিনের বাড়িতে ঢোকার ঠিক ডানেই, বড় পুকুর। নেজাম মিয়ার বাসা নামেই পরিচিত। কিন্তু একসময় সেটি তার চেয়েও বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছিল, ঝিলুর বাসা হিসেবে। বাড়ির উঠানের ঠিক মাঝখানে একটি কাঁঠাল গাছ। তার গায়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করা ছিল-‘ঝিলু দি গ্রেট’। শুধু সেই কাঁঠাল গাছেই নয়, বাসার এখানে-সেখানে, বাদবাকি দেয়ালে ঝিলু তার এই গ্রেটনেসের ঘোষণা লিখে রাখত। তখন বয়স আর কত হবে, ঝিলু পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।

খুব সুন্দর ছবি আঁকত ঝিলু। ছবি আঁকা ছিল আরেক নেশা। কিন্তু সবচেয়ে বড় নেশা ছিল গান গাওয়া। দিন-রাত প্রায় সারাক্ষণ ঠোঁটে লেগে থাকত গানের কলি। মুম্বাই ও কলকাতার ছায়াছবির হিট গানগুলো নির্ভুল সুরে নিখাদ দরদে গাইত ঝিলু।

শরতের এক দুপুর, পুকুরের ঘন সবুজ জলে পুরো শরীর ডুবিয়ে শুধু মাথা বের করা একটি দশ বছরের ছেলেকে দেখা যায়। বাদামী গায়ের রঙ, হ্যাংলা, ডাগর দুটি চোখ তার। পুকুরের জলে শুধু মাথা বের করে উচ্চকণ্ঠে গান করছে সে। আর পুকুরের ঘাটে খেলার সাথীরা মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনছে। 

আরও পড়ুন : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস 
 
আগামীকাল শুক্রবার, ভোরে ক্বারী সাহেব আসবেন, কোরআন তেলাওয়াত শেখানোর জন্য। নতুন শোনা গজলের সুরে তাকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতে গভীর ব্যস্ততা, জলে ডুবে তাই রেওয়াজ চলছে সারা দুপুর জুড়ে।

সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ। সুরেই জীবন, সুরেই যাপন। বায়ান্ন থেকে একাত্তর আলতাফ মাহমুদ জীবন যাপন করেছেন যেন এক আলোকিত সুরের ধূমকেতু হয়ে।

প্রতিদিন ভোরে রুটিন কাজ কোরআন তেলাওয়াত করা। দরাজ কণ্ঠে তেলাওয়াত করে সে। ক্বারী সাহেব খুব গর্ব করে বলে বেড়ান, অনেক তালবিলিম (তালবে ইলম) আমি দেখেছি। কতজনই তো আমার কাছে কোরআন শরিফ পড়ে, কতজনকেই তো তেলাওয়াত শেখালাম, কিন্তু এই ছেলেটির মতো এমনটি আর পাইনি। এত সুন্দর দরাজ গলা, এত সুন্দর এলহানের কাজ, চেষ্টা করলে ও একজন বড় ক্বারী হতে পারবে। এই প্রশংসা শুনতে পেরে আরও বেশি রেওয়াজ শুরু তার। 

শুক্রবার যথানিয়মে তেলাওয়াত করছে সে। আর ক্বারি সাহেব শুনছেন। শুনে বললেন, সুবহানাল্লাহ। আজকে তোর তেলাওয়াত খুব ভালো হয়েছে রে। কিন্তু তোকে তো এমন কোনো লেহান আমি শিখাইনি। কোত্থেকে শিখলি?

আরও পড়ুন : লুৎফুন্নাহার হেলেন : বিস্মৃতির অতলে থাকা বুদ্ধিজীবী

মিট মিট করে হাসে সে। কিছুতেই বলতে নারাজ। ক্বারির অনেক চাপাচাপিতে খুব আগ্রহ করে বলে, একটি বিখ্যাত গজলের সুরে আজ কোরআন তেলাওয়াত করেছি, সুন্দর না! সাথে সাথে গালে ঠাস, চড়। রেগে বেরিয়ে গেলেন ক্বারি। বিশাল নালিশ হলো তার বাবা নেজাম আলীর কাছে। 

সে বুঝে গিয়েছিল ঝড় আসছে তার উপর। পিঠ বাঁচাতে লুকিয়ে ভোঁ দৌড়। সামনের মাঠ ছেড়ে, সাদা উঁচু কাশফুলের বন পেরিয়ে একদমে বাইদা নদীর বেদে পাড়ায় গিয়ে নৌকায় আশ্রয় নিল সে। এখানে সবাই চেনে তাকে।

প্রায় সময়ই ছেলেটি আসে, গান আর বাঁশির টানে সময় কাটায়। কখনো কখনো সে গানও শোনায় তাদের। বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে মাঝে মাঝে বেসুরো সুর তোলে, বাঁশির হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল নিজের অজান্তেই। নির্ভয়ে থাকবার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা তার। বাড়িতে ঝড় কমলে তারপর ফেরা যাবে।

এদিকে দুপুর গড়ায়, ভাত খাওয়ার সময় যায়। সে বাড়ি ফেরেনি। নেজাম আলী খবর পেয়ে খুঁজতে বের হয়। না কোথাও নেই তার ছেলেটি। পথের ধারে ক্বারী সাহেবের সাথে দেখা তার। সকালের অঘটনটির পর থেকে ছেলেটি বাড়িতে আসেনি জানতেই ক্বারী সাহেব বলেন, বাইদা নদীর ওখানে আছে। আমি ওদিক দিয়ে যাওয়া আসা করলেই তাকে দেখেছি প্রায়।

আলতাফ মাহমুদ থেমে থাকেননি। তার সুর বেজেই চলেছে সময়ের হাত ধরে। শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য তার প্রধান অস্ত্র ছিল সুর।

বেদে পরিবারের সাথে গান গাইতে দেখেছি। ওখানেই ওকে পাবেন। মারামারি করার দরকার নেই। এত সুমধুর কণ্ঠ তার। শুধু খেয়াল রাখবেন যেন বড় হয়ে গানবাজনার পাগলামিতে মন না যায়। জীবনটা নষ্ট না হয়ে যায়। 

বাড়ি ফিরতেই নেজাম আলী উচ্চকণ্ঠে বললেন, গাছে খোদাই কইরা আর গানবাজনা কইরা কি আর ঝিলু দি গ্রেট হওন যায় রে! পড়াশোনা না করলে কোনদিনও তুই গ্রেট হইতে পারবি না।

আরও পড়ুন : মুনীর চৌধুরী : অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিবিম্ব 

বাড়ির পেছনে চাপকলের জলে গা হাত পা ধুতে ধুতে ঝিলু উত্তর দিচ্ছিল, আমি ঝিলু দি গ্রেট হইয়াই দেখামু। সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ। সুরেই জীবন, সুরেই যাপন। বায়ান্ন থেকে একাত্তর আলতাফ মাহমুদ জীবন যাপন করেছেন যেন এক আলোকিত সুরের ধূমকেতু হয়ে।

শত্রুর দুর্গম ধূম্রজালকে সরিয়ে দিয়েছেন নিজের সুরের মোহে। শত্রুকে ঘায়েল করেছেন সুরের তাল-লয়ে। গণমানুষকে সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ করে রেখেছেন রাতভর।

গ্রাম হোক বা শহর, কাঁধে হারমোনিয়াম নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে চলেছেন গান। বাংলার আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছেন গণসংগীত, আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। অথচ সেই সময়কার আইয়ুবী-মোনায়েম শাসনামলে বাংলাদেশ কেন্দ্রিক দেশাত্মবোধক বা গণসংগীত পরিবেশন শাসক মহলে গর্হিত বা এক ধরনের দেশদ্রোহিতার সামিল বলে মনে করা হতো।

আলতাফ মাহমুদ থেমে থাকেননি। তার সুর বেজেই চলেছে সময়ের হাত ধরে। শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য তার প্রধান অস্ত্র ছিল সুর।

দীর্ঘদেহী গাঢ় গায়ের রঙে, ঝাঁকড়া কেশ দুলিয়ে তিনি যুদ্ধ করে গেছেন রাজপথ, জনপথে। হাতিয়ার ছিল তার কণ্ঠ, সুর আর গান। সংগীতকে বিপ্লবের আরেকটি নাম দিয়েছিলেন, আলতাফ মাহমুদ। আমার চোখে সে একজন বাবা, একজন ঝিলু দি গ্রেট।  

শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা