একসময় সারা বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু ছিল গুলিস্তান। দেশের সব বাস এসে থামতো গুলিস্তানে। মনে আছে ছেলেবেলায় বাবার সাথে ঢাকায় এসে গুলিস্তানে নেমে ডানদিকে তাকাতেই বায়তুল মোকাররম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। এতদিন পত্রিকা বা ক্যালেন্ডারের পাতায় ছবি দেখে দেখে বায়তুল মোকাররম অনেক চেনা ছিল। তবু স্বচক্ষে দেখার আনন্দ ভুলিনি এখনো।

বায়তুল মোকাররমে যেতে যতে পথে পড়ল আরেক বিস্ময় গুলিস্তানের কামান। আরেকটু এগোতেই স্টেডিয়াম। কাছ থেকে তখনো দেখা না হলেও এই স্টেডিয়াম ছিল আমাদের বহু আনন্দ-বেদনার উৎস। আবদার করে এক ফাঁকে শাপলা চত্বরও দেখা হয়ে গেল। আজিমপুরে চাচার বাসায় যেতে যেতে দেখলাম সচিবালয়, হাইকোর্ট, কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার—বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়। আনন্দ যেন বাধ মানে না। বলছিলাম গুলিস্তানের কথা।

এক সময় ঢাকার মূল রেলস্টেশন ছিল ফুলবাড়িয়া। আর ঢাকার শেষ সীমানাও ছিল এই ফুলবাড়িয়া আর গুলিস্তান। রেলস্টেশন ফুলবাড়িয়া থেকে কমলাপুরে সরিয়ে নেওয়া হয় স্বাধীনতার আগেই। আর আশির দশকে গুলিস্তান থেকে বাস স্টেশন সরিয়ে নেওয়া হয় সায়েদাবাদ, গাবতলী আর মহাখালীতে। সরানোর সময় এই সবগুলোই ছিল শহরের বাইরের প্রান্তে। কিন্তু কমলাপুর, সায়েদাবাদ, গাবতলী আর মহাখালী এখন দ্রুত বর্ধনশীল ঢাকার ভেতরে। সময় এসেছে আরেক দফা সরানোর।

একসময় ঢাকা মানে ছিল বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী এলাকা। গুলিস্তান আর ফুলবাড়িয়া ছিল শেষ সীমানা। ধানমন্ডি-লালমাটিয়ায় একসময় ধানচাষ হতো। গুলশান এলাকা ছিল গণ্ডগ্রাম। বাড়তে বাড়তে ঢাকা এখন উত্তরা ছাড়িয়ে গাজীপুরের দিকে ধাবমান, পূর্বে পূর্বাচল, পশ্চিমে আশুলিয়া আর রায়ের বাজার নিয়ে ঢাকা এখন দুই সিটি করপোরেশনের মহানগরী। 

ঢাকা এখন বসবাস যোগ্যতায় তলানিতে। বছর জুড়ে যানজটে স্থবির। বর্ষাকালে এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে তিন ঘণ্টা পানি আটকে থাকে। যতই উন্নয়ন হোক, সেটি পরিকল্পিত না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপই হবে শুধু।

ঢাকা বড় হচ্ছে, এটা আনন্দের সংবাদ। কিন্তু সমস্যা হলো, বাড়ছে ইচ্ছেমতো। অপরিকল্পিত নগরায়নের চাপে ঢাকার এখন ঢাকা পড়ে যাওয়ার দশা। একসময় ওয়ারী ছিল ঢাকার সবচেয়ে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। তারপর একে একে ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা গড়ে ওঠে। এখন গড়ে উঠছে পূর্বাচল। আর বেসরকারি নানা আবাসিক এলাকা তো আছেই।

পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন আর সম্প্রসারণ করতে পারলে ঢাকা হতে পারতো বিশ্বের অন্যতম সেরা সুন্দর শহর। সেই ঢাকা এখন বসবাস যোগ্যতায় তলানিতে। বছর জুড়ে যানজটে স্থবির। বর্ষাকালে এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে তিন ঘণ্টা পানি আটকে থাকে। যতই উন্নয়ন হোক, সেটি পরিকল্পিত না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপই হবে শুধু। সকল নিচু জমি ভরাট করে উঁচু ভবন বানালে আমাদের তো পানির নিচেই থাকতে হবে। জলাবদ্ধতা তো আমরা ডেকে এনেছি।

চারপাশে এখন উন্নয়নের জোয়ার। ফ্লাইওভার, ইউলুপ, এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু—বিস্ময়কর সব উন্নয়ন প্রকল্প চারদিকে। সব উন্নয়নই দৃশ্যমান, চোখের সামনে হচ্ছে। অবশ্য বিরোধীদের বিরোধিতার অন্ত নেই। তাদের যুক্তি হলো, উন্নয়ন তো আর শেখ হাসিনার টাকায় হচ্ছে না, জনগণের টাকায় হচ্ছে। কিন্তু ভাই, জনগণের টাকা তো আগেও ছিল, তখন উন্নয়ন হয়নি কেন?

শুধু টাকা থাকলেও উন্নয়ন হয় না। উন্নয়ন করতে, দেশকে এগিয়ে নিতে সাহস লাগে, দূরদৃষ্টি লাগে। এটা ঠিক উন্নয়ন মানেই অর্থ। আর সেই অর্থে কেউ না কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। একের পর এক উন্নয়ন হলেও তা ব্যয় অনুপাতে জনগণের সর্বোচ্চ কাজে লাগছে কি না, সেটা বিচার করাটাও জরুরি। অপরিকল্পিত উন্নয়নে দায় বহন করতে হয় জনগণকে।

ঢাকার রাস্তাগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ি হয় বছর জুড়ে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। আজ এই সংস্থা কাটে তো, কাল ঐ সংস্থা। একবারে কাটলে মানুষের ভোগান্তি কমে। ব্যয় হয় একবার। একই রাস্তা বারবার না খুঁড়লে, বারবার টাকা আসবে কোত্থেকে? আর বারবার টাকা না আসলে কিছু মানুষের আঙুল ফুলবে কীভাবে?
মেট্রোরেল হচ্ছে খুব ভালো কথা। কিন্তু এই মেট্রোরেলের জন্য ঢাকার কত মানুষকে কত বছর ধরে কত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে; তার কোনো হিসাব কি কারো কাছে আছে? আসলে জনগণের দুর্ভোগকে কেউ পরোয়াই করে না।

শুধু টাকা থাকলেও উন্নয়ন হয় না। উন্নয়ন করতে, দেশকে এগিয়ে নিতে সাহস লাগে, দূরদৃষ্টি লাগে। এটা ঠিক উন্নয়ন মানেই অর্থ। আর সেই অর্থে কেউ না কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।

জাকার্তা আর বাংলাদেশে একসাথে মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয়েছে। জাকার্তায় মেট্রোরেল চালু হয়ে গেছে গতবছরই। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুরের ১২ কিলোমিটার রাস্তা কোটি মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে আছে দশক ধরে। ১২ কিলোমিটার রাস্তা স্বর্ণ দিয়ে বাধিয়ে দিতেও তো এরচেয়ে কম সময় লাগার কথা। উন্নয়নের প্রসব বেদনা আমরা সইবো। কিন্তু অসহনীয় বেদনা যেন প্রসূতিকেই মেরে না ফেলে। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের মানুষের কী অপরাধ, কেন তাদের ১২ কিলোমিটারের গ্যাঁড়াকলে আটকে থাকতে হবে বছরের পর বছর।

উন্নয়নের সাথে দূরদৃষ্টি থাকা খুব জরুরি। ঢাকার চারপাশে কয়েকটি সেতু হয়েছে কয়েকবছর আগে। এখন বলা হচ্ছে, সেতুগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কারণ সেতুগুলো নৌ চলাচলের মতো যথেষ্ট উঁচু নয়। এখন যে প্রকৌশলী এই সেতুগুলোর ডিজাইন করেছে, যারা এটা নির্মাণ করেছে তাদের খুঁজে এনে শাস্তি দেওয়া উচিত। এইটুকু জ্ঞান যার নেই, তাকে এত বড় সেতু বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো কেন?

ইন্টারনেটের যুগে গোটা বিশ্বই এখন হাতের মুঠোয়। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে সব জানা সম্ভব মুহূর্তের মধ্যেই। চাইলে সরেজমিন গিয়েও দেখে আসা সম্ভব। আমরা পুকুর খনন শিখতে একসাথে বিদেশ যাই আর একটা বড় সেতু বা ফ্লাইওভার বানানোর আগে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখি না। ফ্লাইওভার বানানো শুরু করার পর ডিজাইন চেঞ্জ করতে হয়।

পূর্বাচল উপশহরের সাথে ঢাকার সংযোগের জন্য ৩০০ ফিট চওড়া পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে বানানো হলো। পূর্বাচল এখনো চালু হয়নি। ২৫ হাজার আবাসিক প্লটে এখনো ভবন হয়নি। সেখানে এখনো স্থানীয়রাই মূলত থাকেন। কিন্তু তাতেই এক্সপ্রেসওয়ে অচল। ছুটির দিনে পুরো এক্সপ্রেসওয়ে স্থবির হয়ে যায়। এখন ৩০০ ফিট এক্সপ্রেসওয়ে হাজার ফুট করা হচ্ছে। মাত্র ১০ বছর পরের চিত্র যারা দেখতে পেল না, সেই পরিকল্পনাবিদ কারা? জনগণের টাকা নিয়ে এভাবে এক্সপেরিমেন্ট করার, লুট করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?

উন্নয়ন অবশ্যই আমরা চাই। তবে নিছক সংখ্যায় নয়, সময় এসেছে টেকসই ও মানসম্পন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার। অন্তত একশ বছর সামনে তাকিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। আর উন্নয়ন কাজ শেষ করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। যাতে জনগণের অর্থের অপচয় না হয় এবং তাদের দিনের পর দিন উন্নয়নের প্রসব বেদনা সইতে না হয়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ