মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি স্কুল-কলেজ খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ আর তারপর ২৪ ঘণ্টাও পার হয়নি এরমধ্যেই ঘোষণা এসেছে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হবে। অথচ বলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথমে খুলে দেওয়া হবে এবং তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী তদনুযায়ী ভ্যাকসিন পেয়েছেনও এবং অনেকেই রেজিস্ট্রেশন করে অপেক্ষায় আছেন। এর মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো স্কুল-কলেজ খোলার এই ঘোষণা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে কোনো সংবাদ এখনো নেই।

সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক যখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর নতুন করে অরাজকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এবং তাদের ছাত্র সংগঠনকে ‘ওয়েল ইকুইপড’ হয়ে মাঠে থাকার নির্দেশ দেন তখনই মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে সরকার হয়তো একটু সময় নেবে।

অনেক স্কুল আর্থিক সংকটের কারণে হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ার কারণে হয়তো অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। এই সবকিছু আমলে না নিয়ে একটি ঘোষণা দিলেই কি হয়ে গেল?

বিশ্ববিদ্যালয় খোলাকে সরকার একটু ঝুঁকিপূর্ণ ভাবছে। তবে সরকার বিরোধী আন্দোলনের চেয়ে সরকারের প্রস্তুতিই আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মনে হয়েছে। এর কারণ হলো, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কিংবা সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট মোকাবিলার জন্য এমন কোনো কাজ কি আমাদের নজরে এসেছে? না, কোনো কাজই আমাদের নজরে আসেনি।

মনে রাখতে হবে, পোস্ট কোভিড-১৯ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আর কোনো গণরুম থাকতে পারবে না। কিন্তু এই বিষয়ে যেহেতু কোনো কাজই হয়নি তাই এই সংকটকে এড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণভাবে খোলার কোনো সুযোগও নেই।

সারা বিশ্বের সব দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ খুলে দিলেও বাংলাদেশ পারবে না। বড়জোর আমরা কোনো একটি নির্দিষ্ট বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল খোলা রাখতে পারি যাদের কেবল পরীক্ষা ও ল্যাব চলবে। আর বাকিদের অনলাইনে ক্লাস চলতে পারে।

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে ভাবছি আর স্কুল খোলার দাবি জানাচ্ছি, সেই মুহূর্তে দেখি স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার ঘোষণা। অথচ পোস্ট কোভিড-১৯ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে একটা প্রস্তুতি লাগবে এবং পূর্ণভাবে খোলার আগে একটু বিকল্প পদ্ধতিতে আংশিক খুলে পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণের পর কেবল পূর্ণভাবে খোলার ঘোষণা আসতে পারতো।

শিক্ষায় বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের স্কুল-কলেজে গিয়ে দেখবে সেটি আর নেই।

এমন হতে পারে যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থী কেবল সপ্তাহে দুইদিন স্কুলে আসবে। এতে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো যাবে যেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারে। তারপর কথা হলো, স্কুল-কলেজগুলো প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে। সেগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার একটা সময় লাগবে।

করোনাকে বিবেচনায় নিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজিং ও অনেকের একসাথে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। অনেক স্কুল আর্থিক সংকটের কারণে হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষকরা দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ার কারণে হয়তো অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। এই সবকিছু আমলে না নিয়ে একটি ঘোষণা দিলেই কি হয়ে গেল? কোনো পূর্বপ্রস্তুতি লাগবে না?

শিক্ষার্থীদের অনেকেই স্কুল টাইমে অনলাইন কোচিং-এ ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করছে। তারা এখন কী করবে? স্কুলের ক্লাস করবে নাকি কোচিং করবে? আমার কন্যা বলছে, স্কুলে গিয়ে সে কাউকে পাবে না। সবাই নাকি এখন কোচিং ক্লাসেই থাকবে। অথচ তারা জানে না পড়াশোনা মানে কেবল ক্লাস না, বই পড়া না।

স্কুল মানে সামাজিকতা শেখা, কীভাবে বন্ধু তৈরি হয় এবং কেন বন্ধুত্ব ভেঙে যায় সেগুলো শেখাও শিক্ষার একটি অবশ্য শিক্ষণীয় অংশ। স্কুলে না গেলে বড় হয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে কোনো সোনালি স্মৃতি পাবে না। এই স্মৃতিগুলো স্ট্রেসফুল সময়ে মানুষকে স্ট্রেস ডিসচার্জ করতে সাহায্য করে। তাই আগেকার রাজা বাদশাহদের মতো নির্দেশ জারি করে খুলে দেওয়া খুব একটা কাজের কাজ না। সরকারকে এইসব বুঝতে হবে।

শিক্ষায় বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের স্কুল-কলেজে গিয়ে দেখবে সেটি আর নেই। কেউ দেখবে সেটি বিক্রি হয়ে অন্য মালিকানায় চলে গিয়েছে এবং সাথে সাবেক শিক্ষকরাও সেখানে আর নেই। এইগুলোও শিক্ষার্থীদের মনোজগতে দাগ ফেলবে। আশা করি সরকার এইসব বিবেচনায় নেবে।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়