সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত উপন্যাস শবনম (১৯৬০) -এ সিলেটের ছেলে মজনূন ১৯২৭-২৯ সাল নাগাদ কাবুলের একটি কলেজে ইংরেজি ও ফরাসি অধ্যাপনার কাজে গিয়ে পরিচিত হয় স্থানীয় সর্দার আওরঙ্গজেবের কন্যা শবনমের সাথে। তখন বাদশাহ আমানুল্লার শাসনকাল (১৯১৯-২৯) চলছিল, যখন কি না আফগান সমাজে নারী শিক্ষা ও প্রগতির পক্ষে প্রচুর সংস্কার সাধিত হচ্ছে। সেই সময়েরই আধুনিক, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ে শবনমের সাথে বিয়ে হয় বাঙালি মজনূনের।

শবনম অর্থ ‘ভোরের শিশির।’ বাঙালি নায়ক বিয়ের পর আফগান নববধূকে বলছেন যে, তার দেশের এক রাজপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের সাথে বিয়ে হয়েছিল এক আফগান রাজকুমারী গান্ধারীর। ক্ষুদ্র, পার্বত্য, রাজ্য গান্ধারের রাজকন্যাকে অবশ্য পরাক্রমশালী হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজকুমারকেই বিয়ে করতে হয় আর সেই অভিমানেই বোধ করি পতিব্রত্যের নিদর্শন হিসেবে আজীবন চোখে কাপড় বেঁধে চলেছেন চক্ষুষ্মতি সেই রাজকুমারী। 

‘মহাভারত’-এর সময় পার হয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর। আজকের গান্ধার বা আফগানিস্তানের মেয়েরা কেমন আছেন এই তালেবান অগ্রযাত্রার সময়ে? পায়বন্দ সেইয়েদ আলী’র কথাই ধরুন। কাবুলে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন এই আফগান নারী।

‘সুইডিশ কমিটি ফর আফগানিস্তান’-এর শিক্ষা বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে কাজ করা ছাড়াও আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা বিষয়ক সবচেয়ে বড় আর্থিক সহায়তামূলক প্রকল্প জিইসিরও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আগস্টের শেষের দিকে তালেবান বাহিনী যখন কাবুল জয় করার পথে, তখন এই শিক্ষাবিদ ২১ আগস্ট ‘বিবিস নিউজ’কে বলেন যে, ‘আমার মনে হয় না যে নারীর অধিকার এবং শিক্ষার প্রশ্নে তালেবানদের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা বা এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে আদৌ কোনো কাজে আসবে। যদিও মেয়েদের স্কুলগুলো খুলছে, তবে ছাত্রী আসছে খুবই কম।’ 

আর এক আফগান নারী অ্যাকটিভিস্ট পাশতানা জালমাই খান দুররানি বলেন, ‘হেরাতে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না, কান্দাহারে মেয়েদের বলা হয়েছে ঘরেই থাকতে এবং এমনকি ব্যাংকে যে মেয়েরা চাকরি করত, তাদের পদগুলোয় এখন তাদের পুরুষ আত্মীয়দের কাজ করতে বলা হচ্ছে।’

এছাড়াও তালেবানরা যখন নারী অধিকারের কথা বলে, তারা কি মেয়েদের চলাচল, সামাজিক মেলামেশা, রাজনৈতিক অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার অথবা ভোটদানের অধিকারকেও স্বীকার করে কি না, এ প্রশ্নও তিনি তোলেন। 

বিবিসির এই প্রতিবেদনের মূল প্রতিবেদক আলেক্সান্দ্রা ফ্যুশে আরও জানান যে, তালেবানরা আসার দুদিনের মাথাতেই অবশ্য কাবুলের কিছু টিভি চ্যানেলে নারী উপস্থাপকরা ফিরছিলেন। তোলো টিভি’র মতো একটি প্রাইভেট চ্যানেল যা মূলত পশ্চিমা কায়দার গেম শো, সোপ অপেরা এবং বিভিন্ন ট্যালেন্ট প্রতিযোগিতা দেখায়, এই মুহূর্তে অস্বস্তিতে ভুগছে যে, সামনে কী আসবে এবং সাময়িকভাবে তাদের নারী উপস্থাপকদের কাজ থেকে বাতিল করেছে। 

ইতিমধ্যেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে নারী শিক্ষার জন্য প্রচারাভিযান চালিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়া ও পরবর্তীতে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই আফগানিস্তানের নারী ও বালিকাদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে টুইট করেছেন।

মালালা তার টুইটে বলেন, ‘আফগানিস্তানের কিছু নারী অ্যাকটিভিস্টের সাথে আমার কথা হয়েছে এবং তারা সবাই নিজেদের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।’

তাদের অনেকেই ১৯৯৬-২০০১ সময় পর্বে নারী ও বালিকাদের সাথে যেমন আচরণ করা হয়েছে, সেটা নিয়ে চিন্তিত। নিরাপত্তা এবং স্কুলে যাওয়ার অভিগম্যতা নিয়েও তারা চিন্তিত এবং ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি, পত্রপত্রিকায় এই মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে যে, মেয়েদের ভার্সিটি থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনেক মেয়েকেই ১২-১৫ বছরের ভেতরে বিয়ে করতে বলা হচ্ছে।

তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহীন অবশ্য বলেছেন যে, ‘আফগান রীতি-নীতি ও ইসলামী মূল্যবোধ অনুযায়ী নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষিত হবে।’

একটা বিষয় হচ্ছে, গত এক শতাব্দীতে আফগানিস্তানের অনেক শাসকই নারী শিক্ষা ও প্রগতির প্রসার ঘটাতে চেয়েছেন, কিন্তু বারবার তারা হেরে গেছেন অনড়-অচল আফগান গোত্র-ভিত্তিক কঠোর পিতৃতন্ত্র, শরিয়া শাসিত মূল্যবোধ ও নারীর প্রতি হাজার বছরের সনাতন, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে।

আমার মনে হয় না যে নারীর অধিকার এবং শিক্ষার প্রশ্নে তালেবানদের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা বা এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে আদৌ কোনো কাজে আসবে।

ক্যারোলিন আলেকজেন্ডারের ‘দ্যা আপ অ্যান্ড ডাউন হিস্ট্রি অফ আফগান ওমেন্স রাইটস’ প্রবন্ধে (ব্লুমবার্গ ইক্যুয়ালিটি, ১৯ আগস্ট ২০২১) তিনি বলেছেন, গত একশ বছরে আফগান নারীর উত্থান-পতনকে নিচের তিনটি কালপর্বে মূলত বিন্যস্ত করা যায়—

১. বাদশা আমানুল্লাহ খানের শাসনকাল
১৯১৯ সাল থেকে শুরু করে বাদশা আমানুল্লাহ খান পরবর্তী এক যুগ দেশটি শাসন করেন এবং সেই সময়ে তিনি দেশকে আধুনিক করে গড়ে তোলার জন্য পশ্চিমা ধাঁচে সংস্কার কর্মকাণ্ড হাতে নেন। তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই বাদশা আমানুল্লাহ খানও আফগানিস্তানে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন যেখানে নারী অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা, বহুবিবাহ করায় প্রেরণা না দেওয়া এবং ধর্মীয় নেতা বা মোল্লাদের কর্তৃত্ব এসময় হ্রাস করা হয়।

মেয়েদের আর পর্দা করার বা বোরখা পরার দরকার রইল না। এমনকি বাদশার স্ত্রী বেগম সুরাইয়াই কাবুলে প্রথম মেয়েদের স্কুল খোলেন। কিন্তু এত দ্রুতগতিতে সংস্কারে উপজাতীয় গোত্র-ভিত্তিক, রক্ষণশীল আফগান সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে বিদ্রোহ করে। এক পর্যায়ে বাদশাহ আমানুল্লাহকে ১৯২৯ সালে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয়। তার উত্তরাধিকারী মোহাম্মদ নাদির শাহ পূর্ববর্তী শাসকের গৃহীত নানা প্রগতিশীল নীতিমালা বাতিল করলে আফগান সমাজের অগ্রসর অংশ ক্ষুব্ধ হলেও তাদের ক্ষোভ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে ১৯৩৩-১৯৭৩ সাল নাগাদ জহির শাহ নামে আফগানিস্তানের শেষ নৃপতি বাদশাহ আমানুল্লাহর গৃহীত অনেক পদক্ষেপ পুনরায় চালু করেন। তবে খানিকটা সতর্কতার সাথে। 

গত এক শতাব্দীতে আফগানিস্তানের অনেক শাসকই নারী শিক্ষা ও প্রগতির প্রসার ঘটাতে চেয়েছেন, কিন্তু বারবার তারা হেরে গেছেন অনড়-অচল আফগান গোত্র-ভিত্তিক কঠোর পিতৃতন্ত্র, শরিয়া শাসিত মূল্যবোধ ও নারীর প্রতি হাজার বছরের সনাতন, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে।

১৯৬৪ সালে আফগান নারীরা একটি নতুন সংবিধান রচনার প্রক্রিয়াতেও সামিল হয়েছিলেন যা তাদের ভোটাধিকার এবং নির্বাচিত হওয়ার অধিকারও প্রদান করে। আফগান মেয়েরা এরপর থেকে চাকরি পায়, ব্যবসা দাঁড় করায় এবং রাজনীতিতেও প্রবেশ করে। 

২. রাজতন্ত্র শেষ হওয়ার পরে
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সমর্থক জেনারেল যিনি জহির শাহকে ক্ষমতা থেকে সরাবেন, তিনিই আবার একটি সামরিক ক্যুদেতায় নিহত হবেন এবং তারপরই সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তানে ঢুকে, তাদের মনোনীত এক মার্ক্সবাদী সরকারকে ক্ষমতায় বসাবে। কমিউনিস্ট সরকার নারী প্রগতিতে অনেক ভূমিকা রাখলেও কমিউনিস্ট বাহিনী ও তাদের বিরোধী ইসলামী দলগুলো বা মুজাহিদীনদের দ্বি-পাক্ষিক সংঘর্ষে দেশটি যতই গৃহযুদ্ধে ডুবে যেতে থাকল, ততই সমাজে মেয়েদের অবস্থান অবনমিত হতে থাকে।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর মাদরাসার ছাত্রদের আন্দোলন বা তালেবান আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মুখে শান্তি ও আধুনিক সরকারের কথা বললেও ১৯৯৬-২০০১ সাল নাগাদ তালেবান শাসনের সময়টি মেয়েদের জন্য ছিল প্রচণ্ড কঠোর। মেয়েদের এসময় স্কুল, চাকরি, প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয় এবং এমনকি কোনো পুরুষ আত্মীয়কে সাথে নিয়ে বের হওয়াও নিষিদ্ধ হয়। সেই সাথে বোরখাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। এসব না মানলে তাদের প্রকাশ্যে চাবুক মারা ও পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিধান দেওয়া হয়। 

১৯৯৬-২০০১ সাল নাগাদ তালেবান শাসনের সময়টি মেয়েদের জন্য ছিল প্রচণ্ড কঠোর। মেয়েদের এসময় স্কুল, চাকরি, প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয় এবং এমনকি কোনো পুরুষ আত্মীয়কে সাথে নিয়ে বের হওয়াও নিষিদ্ধ হয়।

মেয়েদের ভেতর এসময় আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। শুধুমাত্র ‘নারীর জন্য পরিচালিত হবে’ এমন হাসপাতালেই মেয়েদের যেতে হবে এমন নির্দেশের জন্য প্রচুর মেয়ে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হন। রাজনৈতিক জীবন থেকেও মেয়েরা বহিষ্কৃত হন। 

৩. মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে আশ্রয় নিলে মার্কিন সরকার তালেবান সরকারকে তাদের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে বলে তালেবান সরকার সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে তালেবান সরকারের পতন হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে একটি ‘জাতি গঠন’ প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেয় যার অন্যতম একটি কেন্দ্রীয় অভিমুখ হয়ে ওঠে আফগান নারী ও শিশুদের উন্নয়ন।

২০০৪ সালে দেশটির নতুন সংবিধান গৃহীত হয় যেখানে নারীর উন্নয়নের জন্য কোটা ব্যবস্থা বরাদ্দ করা ছাড়াও তারা যেন দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। নারী ও মেয়েরা সেনাবাহিনী ও পুলিশে অংশ নেয়, সার্জন হিসেবে প্রশিক্ষিত হয়, বিচারক হয় এবং সাংবাদিক, অনুবাদক ও টেলিভিশনে উপস্থাপক হিসেবেও কাজে যোগ দেয়। তবে এসময়ে আফগান নারী প্রগতির পথে অনেক প্রতিবন্ধকতাও ছিল।

গ্রামীণ অঞ্চলে ধর্মীয়-সামাজিক বিধি-বিধানের নামে তত সংস্কার হয়নি। দৃঢ়, কেন্দ্রীয় শাসনের অভাবে দুর্গম এলাকাগুলোতে মোল্লা আর বন্দুকধারী নানা যোদ্ধাদের শাসনই চলে। সেসব জায়গায় নারী অধিকার তেমন একটা বাস্তবে ছিল না। এসব যোদ্ধা বা মিলিশিয়া সদস্যদের দ্বারা সংগঠিত ধর্ষণ এবং নানা যৌন নিগ্রহের ঘটনাগুলো অহরহ ঘটতো।

গ্রামে কিন্তু মেয়েদের চলাচল স্বাধীন ছিল না এবং প্রায়ই তাদের বোরখা পরতে হতো। অনেক সময় এক পরিবারের সাথে আর এক পরিবার বা এক গোত্রের সাথে আর এক গোত্রের বিবাদ বা বিরোধ মেটাতে একটি মেয়েকে অনেক সময় প্রতিপক্ষ পরিবার বা গোত্রে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে দেওয়া হয়। বাল্যবিবাহ বা জোরপূর্বক বিবাহের হার গ্রামীণ অঞ্চলে ছিল খুবই চড়া। 

যদিও নতুন তালেবান সরকার বলছে যে তারা ‘মেয়েদের অধিকারকে শরিয়া আইনের নিয়ম মেনে সম্মান জানাবে’ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন যে, তার প্রতিষ্ঠান ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গা হিম করে দেওয়া সব প্রতিবেদন পাচ্ছেন।’ এদের ভেতর মেয়েদের প্রতিই সর্বোচ্চ মাত্রায় নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে।

সম্প্রতি দেশের উত্তরাঞ্চলে মিলিশিয়া যোদ্ধারা ‘আফগানিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক’র নারী কর্মকর্তাদের কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে বলেছে। প্রচুর জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনাও ঘটছে। দেশটির নানা জায়গায় বারো থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী অবিবাহিত নারীদের স্ত্রী হিসেবে চাইছে তালেবান যোদ্ধারা।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক