প্রতি বছর সরকারি নিয়ম মেনে সরকারি নথিভুক্ত হয়ে গড়ে যে সাত লাখ বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষ মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে কাজের সন্ধানে যায়, তারা সকলে কিন্তু হতদরিদ্র বা দরিদ্র সীমার নিচে নয়। তবে তাদের বেশিরভাগ নারী-পুরুষ দরিদ্র, স্বল্প শিক্ষিত, প্রায় অদক্ষ গ্রামীণ বাংলাদেশের পরিবারভুক্ত।

করোনাকালে এই পরিসংখ্যান যেমন অনেক নিচে নেমে গেছে, তেমনি সরকারি পরিসংখ্যানের বাইরে কতজন নানারকম অবৈধ পথে প্রবাসে যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব কারো কাছে না থাকলেও, নেহাত নগণ্য বা হাতে গোনা নয়।

আবার অবৈধভাবে প্রবাসে অবস্থানকারীদের মধ্যে অনেকেই কিছুটা শিক্ষিত এবং নিম্নবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কাজেই যেসব বাংলাদেশি অবৈধভাবে বিদেশ যান বা বিদেশ যাওয়ার পরে অবৈধ অভিবাসী হয়ে পড়েন, তারা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অসাধু পথে বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়ায় জড়ান না। তার মূল কারণ ভিন্ন। 

প্রথম কারণ, বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা ও সরকারি-বেসরকারি দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়, আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতিও নেই। বাংলাদেশিরা বিদেশে পড়তেই যাক, কারখানায় কাজ করতে যাক আর পেশাজীবী হিসেবেই বিদেশ যাক – তার যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরীক্ষায় উতরাতে হবে, তবেই তাকে অন্য দেশে বিবেচনায় নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো সনদই বিদেশে কাজে লাগে না। কাজেই নিয়ম মেনে বিদেশে কাজ করতে যেতে চাইলে ভালো কাজ বা পারিশ্রমিকের কাজ পাওয়া তো দূরের কথা, বিদেশে যাওয়ার সম্ভাবনাই ক্ষীণ হয়ে আসে।

তারুণ্যের ধর্মই হলো, সে সাহসী। যেকোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না। কাজেই অনিশ্চিত বিপদসংকুল যাত্রা তাকে বিচলিত করে না।

দ্বিতীয় কারণ, নিয়ম ভঙ্গের প্রলোভন ও বিদেশ যাওয়ার সহজ উপায়। অনেক ক্ষেত্রেই আইন ভঙ্গের নজরদারি গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছায় না, যেকোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন বা সনদ যখন টাকা দিয়ে কেনা যায় – তখন কিছু, এমনকি অনেক বেশি টাকা দিয়ে বিদেশে যাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। এই প্রলোভন দেখায় গ্রাম পর্যায়ে কিছু এজেন্ট, যাদেরকে দালালও বলা হয় আর একসময় আদম ব্যাপারী বলা হতো।

এদের যেমন ঢাকা ও বিদেশে নথিভুক্ত এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ আছে, তেমনি মানব পাচার চক্রের সাথেও যোগাযোগ থাকে। প্রয়োজনমতো সরকারি অফিসেও চেনাজানা আছে। তাই সেই লোক বা মহিলা বেআইনি কাজ করছে জেনেও অনেক সময় তার সাথে বিদেশে কাজ প্রত্যাশীরা অনেক টাকা দিয়ে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ গ্রহণ করে।

কোনো দেশে কাজ করতে যেতে পাসপোর্ট, কাজ করার ভিসা, টিকেট আর কিছু আনুষঙ্গিক খরচের জন্য যেখানে সত্তর হাজার থেকে এক লাখ টাকা লাগে, লাইসেন্স বিহীন এজেন্টের সাথে ‘প্যাকেজ ডিল’-এ তার চেয়ে কয়েক গুণ টাকা দিতে হয় যেখানে বিদেশ যাওয়া ও কাজ পাওয়ারই কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু মানুষ এই দ্বিতীয় পথ বেছে নেয় কারণ তার নিজেকে কিছুই করতে হয় না ঐ অতিরিক্ত টাকার বিনময়ে। 

তৃতীয় কারণ, আগে যারা বিদেশ গেছে, তাদের অনেকেই নিয়ম না মানা পথে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত বিদেশে টিকে গেছে। টিকে না গেলেও বা প্রবাসে গিয়ে বিপদে পড়লেও সেই খবর দেশে পৌঁছায় না।

একটি সাফল্য গাঁথা যেমন কয়েকশ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি একটি অসফল অভিবাসন, এমনকি মৃত্যু কয়েকশ মানুষকে নিরুৎসাহিত করে না।

অভিবাসন প্রবণ এলাকায় সফল বিদেশগামী বা বিদেশ ফেরতের কাহিনি বেশি ফলাও করে প্রকাশ পেয়ে আসছে কয়েক যুগ ধরে। এর মাঝে যাদের খবর আসে বিদেশে নির্যাতনের, প্রতারণার বা মৃত্যুর, তাদের চেয়ে যাদের কোনো খবর নেই তাদের সংখ্যা ঢের বেশি। কাজেই স্বপ্নের প্রবাসের অজানা পরিণতিকে সফলতার কাহিনি কল্পনা করে নিয়েই একজন গ্রামবাসী যেকোনো উপায়ে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকে। আর দেশে থেকেও যাদের কর্মসংস্থান হয় না, হলেও আয় খুব নগণ্য, শিক্ষা ও যোগ্যতা কম—তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যেতে চেষ্টা করাকে মন্দের ভালো মনে করে অনেকেই। 

শেষ যে কারণটি উল্লেখ করব তা হলো, শ্রম অভিবাসন বা অন্য যেকোনো ধরনের অভিবাসন প্রত্যাশীরা বয়সে তরুণ—কুড়ি থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেক সময় আরও কম বয়স থাকে, যদিও সেটা বৈধ নয়।

তারুণ্যের ধর্মই হলো, সে সাহসী। যেকোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না। কাজেই অনিশ্চিত বিপদসংকুল যাত্রা তাকে বিচলিত করে না। অনেক বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা প্রতিকূলতা নিয়ে বহু বছর ধরে গেছেন এবং আজও যাচ্ছেন। কেউ কেউ অনেক সংগ্রামের পর সাফল্যের মুখ দেখেন, অনেকে অবৈধ থেকে বৈধ অভিবাসী হয়ে ওঠেন, এমনকি প্রবাসে স্থায়ী নিবাসও গড়ে তোলেন।

একটি সাফল্য গাঁথা যেমন কয়েকশ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি একটি অসফল অভিবাসন, এমনকি মৃত্যু কয়েকশ মানুষকে নিরুৎসাহিত করে না। এই প্রবণতা, এই মানসিকতা কয়েকশ বছরের এবং শুধু বাংলাদেশিদের মাঝে নয়। এর পরিবর্তন কাম্য, তবে সহজ নয় বলেই সেই পরিবর্তন এখনো হয়নি বা হবে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। 

আসিফ মুনীর ।। মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী