আমার চোখে সমস্যা, এজন্য বদ্যি বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজেই বুঝতে পারি। আমি যেমন পাতা ঝরতে দেখি, সকলে দেখে টাকা উড়তে। এক সময় টাকা শুধু ঢাকা শহরে উড়ত। আমি দেখতাম বালির ঘূর্ণি। অন্যরা দেখত লোভের রংধনু। রংধনুর রং এখন আর ঢাকা শহরের চৌহুদ্দির মধ্যে নেই। রং এখন ঘূর্ণি ঝড়ে রূপ নিয়ে কাঁপন তুলেছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। আকাশ মেঘ বালির সামিয়ানা তুলেনি, তুলেছে টাকার সামিয়ানা।

সকলে সেই টাকার আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। পৃথিবীতে কম দিন তো হলো না। চোখের জ্যোতি যখন কৈশোরে ছিল, পার হচ্ছিল তারুণ্য তখন দেখেছি চারপাশের লোভাতুর জিভ, চোখ। কোমরে, গলায়, বাজুতে তাবিজ বাঁধতে দেখেছি, মুফতে বাড়তি কিছু পাওয়ার আশায়। কোনো টাকা, মেধা ও পরিশ্রম ছাড়াই। গুপ্ত বাসনা ছিল অন্যকে ঠকিয়ে, ফাঁকি দিয়ে সকল লাভ নিজের মুঠোতে নেওয়ার। ফকির, মাজারের তদবিরে বিশেষ লাভের আশায় ছুটতে দেখেছি। বাঙালির দিবা রাত্রির স্বপ্নের নিয়মিত চরিত্র- আশ্চর্য প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্য। যার হাত ধরে উঠে যেতে চায় লোভের পর্বত চূড়ায়।

দেখেছি লটারির পেছনে চিতার মতো ছুটে যেতে। কোনো কল্যাণে দানবীর হওয়ার মাহাত্ম্য নয়, দশ দশ করে লটারি বুক পকেটে নিয়ে ঘোরা লাখপতি, কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। লটারি কিনে কে কবে লাখপতি, কোটিপতি হয়েছে জানি না। শুধু খবর পেয়েছি- কারো না কারো লাইগ্যা গেছে! কিন্তু লটারিতেও বাসনা কামনা জিইয়ে রাখা যায়নি। চাই আরও আরও। একজন নয়। দরকার একজনের নয়, সকলের।

লটারির বদলে মানুষ ছুটতে শুরু করে দুর্নীতির চেরাগের দিকে। যেখানে হাত ছোঁয়ালেই শুধু কোটিপতিই নয়, হাজার কোটিপতি হওয়ার অপার সম্ভাবনা। জনতা সেই পূর্বাভাসে ভেসে বেড়াতে শুরু করে। সকলে যে দুর্নীতির ভেলায় ভেসে বেড়ানোর সুযোগ পান তা নয়। ঘাটে দাঁড়িয়ে তাদের কেবল লোভের জল ফেলতেও দেখা যায়। এই ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের জন্য মায়া বাড়ে ভেলার সওয়ারিদের। তারা ছুঁড়ে দেয় লোভের জাল। যেখানে বৈচা মাছের মতো এসে ধরা দেয় লোভী মানুষেরা।

একুশ শতকে তারা নিয়ে আসে ই-কমার্সের ফাঁদ। এবার আর বেকার তরুণরা তাদের শিকারের লক্ষ্য নয়। সকল প্রকার ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ফাঁদে ফেলতে শুরু করে।

ফটকা বাজারে আটকাতে দেখেছিলাম ১৯৯৬ সালে এমন লোভীদের। সেই লোভের আগুনে দগ্ধ ও পুড়ে ছাই হতে দেখেও জিভ খাটো হয়নি। আবার ২০১০ এ দেখলাম চোখ বুঁজে ফটকা বাজারে ঝাঁপ দিতে। আবার নিঃস্ব এবং দেউলিয়া হওয়ার করুণ চিত্রনাট্য।

একই চিত্রনাট্যের অবতারণা হয়েছে এমএলএম বা মাল্টি লেভেল ব্যবসাতে। এক ঝাঁক এমএলএম কোম্পানি মাঠে নামে। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, লোভের টোপে তরুণদের আটকে ফেলা। দেশের কোটি বেকার তারুণ্য ছিল তাদের পুঁজি। সেই বেকারদের চাকরির বিকল্প হিসেবে ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হওয়ার প্রলোভন এবং দ্রুত টাকা আয়ের আলেয়ার আলোর পথ দেখাতে শুরু করে।

সেই প্রলোভনে কেবল বেকার তরুণরাই নয় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষও আটকে যেতে থাকে। পণ্য, জমি, গাছের ব্যবসা দিয়ে স্বনির্ভর এবং টাকা দ্বিগুণ, তিনগুণ করার জাদুকরি চেরাগ নিয়ে যারা আসে তাদের মধ্যে ‘যুবক’, ‘ডেসটিনি’ আলোড়ন তুলে। সারাদেশে তাদের সম্পদ ও গ্রাহক, দুটোই চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।

শুধু কি গ্রাহক? সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও দপ্তরও এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক যোগে কাজ করতে থাকে। রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার করতে এরা পৃষ্ঠপোষক, দাতার ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়। বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে কব্জা করে নেয় গণমাধ্যমকেও।

প্রাকৃতিকভাবেই কোনো অতিই টেকসই হয় না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ডেসটিনি ও যুবকের লোভের বা ব্যবসার ঝাড়বাতি ভেঙে পড়ে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের মাতম এখনো থামেনি।

মাতমের মাঝেই ব্যবসায়ীরা নতুন কৌশলে প্রতারণার জালে ছুঁড়ে দেয় ‘লোভ’। একুশ শতকে তারা নিয়ে আসে ই-কমার্সের ফাঁদ। এবার আর বেকার তরুণরা তাদের শিকারের লক্ষ্য নয়। সকল প্রকার ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ফাঁদে ফেলতে শুরু করে।

বেশি বেশি বিক্রি। আর স্বল্প টাকায় পণ্য কেনার লোভে আটকাতে থাকে ব্যবসায়ী- ভোক্তাদের। পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম নগদ কুপন কিনে ও বাকিতে পণ্য বিক্রি করে একসময় অধৈর্য ও নিঃস্ব হতে থাকে। সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতাদের দীর্ঘশ্বাসের মাঝেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিজেদের বিপণন চালিয়ে যেতে থাকে আক্রমণাত্মকভাবে।

যুবক থেকে ইভ্যালি পর্যন্ত পৌঁছতে গ্রাহক বা আমজনতার কাছ থেকে চলে গেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা উড়তে উড়তে দেশে থাকল, না ভিনদেশে চলে গেল জানা নেই।

সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচি, উদযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। ইভ্যালিকে আইনের জালে ঠিক আটকা পড়তেই হয়। আটকের পর দেখা গেল ইভ্যালির কাছ থেকে পণ্য কিনতে ও পণ্য বিক্রি করতে গ্রাহকরা কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে বসে আছেন। বাজারে ইভ্যালির যে দেনা চারশ তিন কোটি টাকা। আর ইভ্যালির সম্পদ রয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। (২২ জুন ২০২১, ঢাকা পোস্ট)

যুবক থেকে ইভ্যালি পর্যন্ত পৌঁছতে গ্রাহক বা আমজনতার কাছ থেকে চলে গেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা উড়তে উড়তে দেশে থাকল, না ভিনদেশে চলে গেল জানা নেই। তবে টাকা তার মালিক খুঁজে পেয়েছে নিশ্চিত। ইভ্যালিতে দেউলিয়া হওয়ার পরেও আমাদের লকলকে জিভ কিন্তু সংকুচিত হচ্ছে না। ঝুলেই আছে।

আমরা আরেক ই- কমার্স বা প্রতারক প্রতিষ্ঠানের গলায় ঝুলে পড়ছি। শুধু কি ই-কমার্স? কত ইনস্যুরেন্স, সমবায় সমিতি, লিজিং এর প্রলোভন উড়ে বেড়াচ্ছে বাজারে। আমরা ছোটবেলার সেই বিস্কুট দৌড়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে তা মুখে পড়ার প্রতিযোগিতায় আছি।

লোভ দুই পক্ষেরই আছে। এক পক্ষের আছে আলেয়ার আলোর ফাঁদে ফেলে দ্রুত টাকা লুট নেওয়ার লোভ। আরেক পক্ষ সেই আলেয়াকে লাভের আলো ভেবে দ্রুত বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

স্বপ্ন দিবস শেষে দুই পক্ষের যে পরিণতি তাতে সমবেদনার সুযোগ নেই। কারণ সেই অমর বাণীতো আমাদের জানা- লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। ‘স্বেচ্ছায় আত্মহননকারীদের প্রতি- বিশ্রাম শান্তিময় হোক’ এর বেশি বলার সুযোগ নেই।

আমাদের ধারণা হতে পারে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, বৈষম্য আছে বলেই হয়তো আমাদের সমাজে লোভের বীজ অঙ্কুরিত হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। কিন্তু সচ্ছল অর্থনীতির দেশ, সমাজের মানুষও মুফতে বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তারাও লোভের আগুনে ভস্ম হয়। সেই বাস্তবতা দেখে অকপটে বলা যায় - লোভ একটি রোগের নাম।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী