২৫ সেপ্টেম্বর দাঁড়িয়ে কেউ যদি ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরকে মেলাতে চান; তিনি ভুল করবেন, বিভ্রান্ত হবেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ এক সমীহ জাগানিয়া শক্তি। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের এক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র।

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার, গড়ে যা ভারতের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। সম্প্রসারিত টিকা দান কর্মসূচি, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষা জাগানিয়া। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি প্রতীক মাত্র।

সারাদেশেই অবকাঠামো খাতে অভাবিত উন্নয়ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতিতে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু ঠিক ৪৭ বছর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্র, যার চারদিকে শত্রু। ভারত আর রাশিয়া ছাড়া বাংলাদেশের তেমন পরীক্ষিত বন্ধু নেই।

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়েছে বলে ইসলামী বিশ্ব বাংলাদেশকে বাঁকা চোখে দেখে। চীন তো মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আর বাংলাদেশের জন্মটাই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বড় কূটনৈতিক পরাজয়। যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেই ক্ষান্ত হননি, নিজের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করতে চলছিল তার নানা কূটচাল।

সেই সময়ে ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পেল। তার ৭ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দাঁড়ালেন জাতিসংঘের বিখ্যাত মঞ্চে। স্বাভাবিক বিবেচনা কী বলে, বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে ভাষণ দেবেন, বিশ্বের কাছে নিজের দুর্দশার কথা তুলবেন, সহানুভূতি চাইবেন, সাহায্য-সহযোগিতা চাইবেন।

আজকের মতো অনেক কিছু না থাকলেও তখন বাংলাদেশের একজন বন্ধু ছিলেন, বঙ্গবন্ধু। তার বুক ভরা ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বের মানবতার জন্য দরদ আর ছিল অপরিসীম সাহস। সেই সাহসে ভর করে বঙ্গবন্ধু বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির, গাইলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের জয়গান। যে ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিতে পারে, সেই ভাষা কতটা শ্রুতিমধুর, শুনিয়ে দিলেন বিশ্বকে। 

বঙ্গবন্ধুর অনেক বিখ্যাত ভাষণ আছে। সবচেয়ে বিখ্যাত নিশ্চয়ই একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ। যে ভাষণে তিনি একটি জাতির হৃদয়ে মুক্তির স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে একটি শিশু রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে মাতৃভাষায় দেওয়া তার সেই ভাষণটি গোটা বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায়, বিশ্ব শান্তি আর মানবতার জয়গান গাওয়ার এক সাহসী উচ্চারণ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসে।

আজকের মতো অনেক কিছু না থাকলেও তখন বাংলাদেশের একজন বন্ধু ছিলেন, বঙ্গবন্ধু। তার বুক ভরা ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বের মানবতার জন্য দরদ আর ছিল অপরিসীম সাহস।

প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ কারো অনুকম্পার ধার ধারে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, যে বেঁচে থাকতে চায় মাথা উঁচু করেই।  

শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বঙ্গবন্ধু থেকে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব মানবতার নেতায়। আলজেরিয়া, গিনি বিসাউ, ভিয়েতনাম, ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, ‘চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে।’

১৯৭৪ সালের প্রতিকূল পরিবেশে বাংলাদেশের তখন টিকে থাকার সংগ্রাম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রাম তো আছেই, আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ। আর আছে, বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলোর ভ্রুকুটি। বঙ্গবন্ধু সব উড়িয়ে দিলেন এক লহমায়। এক ভাষণেই তিনি বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষাকে চিনিয়ে দিলেন বিশ্বকে। তিনি বুঝিয়ে দিলেন, আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু নিজেদের ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ভুলে যাইনি।

বিশ্বকে সবচেয়ে বড় যে বার্তাটি তিনি দিলেন, তা হলো আত্মমর্যাদার। সেটা শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলোর। তিনি সবাইকে সাহস দিলেন, ন্যায্যতা নিয়ে, মর্যাদা নিয়ে রুখে দাঁড়ালে বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শুরুই করলেন, ‘আজ এই মহা মহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সাথে শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবে।’

আজ এত বছর পর বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি পড়তে গিয়েও বারবার শিহরিত হচ্ছি। শুরুতেই যেমন বলেছি, আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে ৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।  

বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিত করেন বঙ্গবন্ধু অল্প কথায়, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম হইতেছে সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম। আর সেই জন্যই জন্মলগ্ন হইতেই বাংলাদেশ বিশ্বের নিপীড়িত জনতার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আসিতেছে।’ বঙ্গবন্ধুর কথায় বাংলাদেশ আর নিছক একটি ছোট্ট রাষ্ট্র নয়, বিশ্ব শান্তি আর ন্যায়ের প্রতীক হয়ে যায়। 

বঙ্গবন্ধু সব উড়িয়ে দিলেন এক লহমায়। এক ভাষণেই তিনি বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষাকে চিনিয়ে দিলেন বিশ্বকে...

বঙ্গবন্ধু শুধু বলে ক্ষান্ত হননি, পথ দেখিয়েছেন জাতিসংঘকেও, ‘একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপরদিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে, তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিতে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব—যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে। আমরা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন যে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট শুধুমাত্র শান্তি এবং আন্তর্জাতিক সমঝোতার পরিবেশেই সমাধান করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জরুরি ব্যবস্থা নিতে হইবে। ইহাতে শুধুমাত্র এই ধরনের পরিবেশই সৃষ্টি হইবে না, ইহাতে অস্ত্র সজ্জার জন্য যে বিপুল সম্পদ অপচয় হইতেছে, তাহাও মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করা যাইবে।’

৪৭ বছর আগের বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু অল্প কথায় স্পষ্ট করেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও, ‘শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সাথে সৎ প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলে এবং বিশ্বশান্তির অন্বেষার সকল উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে।’

আমি মুগ্ধ হয়ে যাই, যখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি।

আমাদের লক্ষ্য স্ব-নির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তি বিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করিবে, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’

বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন জাতিসংঘে, মানুষের-মানবতার জয়গান গেয়েছিলেন; দেশে-বিদেশে তার অনেকটাই এখনো পূরণ হয়নি। কিন্তু যে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, বিশ্ব মানবতার পথ সেটিই। আমরা জাতি হিসেবে সৌভাগ্যবান, আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন, যিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, বিশ্বের মানুষের মুক্তির দূত। ৪৭ বছর আগেই যিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমাদের ধ্বংস করা যাবে না, মানুষকে ধ্বংস করা যায় না। বাঁচতে হবে আত্মমর্যাদা নিয়ে, মাথা উঁচু করে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ