মানুষের মনে এখন উন্নয়ন স্পৃহা, দেশব্যাপী বড় কাজের বড় নিদর্শন, প্রযুক্তির প্রভাব ঘরে বাইরে সর্বত্র, আধুনিক বিশ্ব হাতের মুঠোয়। আবার দেশ জুড়ে কুযুক্তি ও মৌলবাদী অমানবিকতার প্লাবন। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতার কন্যা, বাঙালির বাতিঘর শেখ হাসিনার আজ জন্মদিন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন। তখন বিদেশে ছিলেন শেখ হাসিনা ও ছোট বোন শেখ রেহানা।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন শেখ হাসিনা। ওই বছর দলের সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৭ মে দেশে ফেরেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয় ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।

শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অতীতের কথা উঠে আসে। উঠে আসে তার পিতা, বাঙালির জনকের কথা। বাংলার সমাজে সৌহার্দ্য আর সহমর্মিতার পাশাপাশি সংঘাতের ইতিহাসও দীর্ঘ। আমাদের বিভাজনের রাজনীতি আছে, জাতীয়তাবাদের মধ্যে সংকীর্ণ আঞ্চলিকতা, ধর্মভেদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে। তবুও বহুত্ববাদের ভেতরকার অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে সরিয়ে সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র এই সমাজে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ তার কন্যার হাতে জাতির নেতৃত্ব।

এ দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের, উদার আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার।

শেখ হাসিনা তার এক লেখায় বলেছেন, ‘পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি’ এবং তিনি যথার্থই বলেছেন যে, তার চলার পথটি বরাবরই বন্ধুর। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে তাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে দেশকে আরও বেশি করে জাপটে ধরল পাকিস্তান প্রেমীরা, যেমনটা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এ দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের, উদার আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। 

তার শাসনামলে গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির স্থিতিশীলতা এসেছে, মানুষের মনে একটা উন্নয়ন স্পৃহা তৈরি হয়েছে। তাই যে বিশ্বব্যাংক প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এ দেশ থেকে, সে নিজ থেকেই সেই দেশকে দারিদ্র্য বিমোচনের রোল মডেল স্বীকৃতি দিয়ে ফিরে আসে উন্নয়নের বড় অংশীদার হতে। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিতে হতদরিদ্র কমেছে, দেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে চলতে শুরু করেছে।

মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে অনিরাপদ শেখ হাসিনা নিজে। যারা বাংলাদেশকে পেছনে দেখতে চায়, সাম্প্রদায়িক দেখতে চায়, জঙ্গি দেখতে চায় তারা সবাই একজোট তাকে হত্যা করার জন্য। কারণ শেখ হাসিনা মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার, শেখ হাসিনা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলা দেশ, শেখ হাসিনা মানে উদার ও প্রগতির বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা মানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাথা উঁচু করে চলা বাংলাদেশ।

একাত্তরের পরাজিত শক্তি যেমন লক্ষ্যে অবিচল তাকে তার পিতার পরিণতি ভোগ করাতে, তৎপর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দেশ ও গোষ্ঠীও। শেখ হাসিনার সামনে তাই পথ হলো অবিচলভাবে এগিয়ে চলা। তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা জানেন। তিনি এদেশের তারুণ্যের স্বপ্ন বোঝেন।

তাই জাতির পিতার কন্যার জন্মদিন উৎসবের সাথে পালনের সময় বাংলাদেশের আত্মার গভীরে গিয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আজ আমাদের বুঝতে হবে কোথায় চলেছি আমরা।

সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার যে আবেগ-নির্ভর শক্তি তাকে মোকাবিলা করার উপায় কী? যারা গণতান্ত্রিক উদার বাংলাদেশ চান, শুভ নিয়তির প্রতি যদি তাদের বিশ্বাস থাকে তবেই বাংলাদেশের আত্মা, যা গঠিত হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধে। তবেই তার চেতনায় চলার লড়াইটা সার্থকভাবে চালানো সম্ভব হবে। 

শেখ হাসিনা কী চান সেটা বোঝাটাই বড়। একদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন, যার মাধ্যমে এক নতুন রাষ্ট্রীয় পরিচয় পাবে এ দেশের মানুষ। অন্যদিকে তার দল সেই পরিচয়কে বড় করে তুলতে কতটা বৃহত্তর পরিসরের রাজনীতি করছে সে প্রচেষ্টাও তাকেই নিতে হয়। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে চ্যালেঞ্জ বহুমুখী।

শেখ হাসিনা মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার, শেখ হাসিনা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলা দেশ, শেখ হাসিনা মানে উদার ও প্রগতির বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা মানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাথা উঁচু করে চলা বাংলাদেশ।

সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা; গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের রূপকার তিনি, মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ তিনি, আবার দলনেত্রী তিনি। বহুবার বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত’ কিন্তু বাংলাদেশ তো তাকে হারাতে চায় না। এ মুহূর্তে তার কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু শেখ হাসিনা ধৈর্য ও সাহসের যেমন প্রতিমূর্তি, তেমনি দেশ ও জাতির বাতিঘর।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি, দুইয়ের সাফল্যই নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় সুশাসনের ওপর। কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা আর আর্থিক অসাম্যর শিকড় বহু যুগ ধরে বিস্তৃত। বিস্তৃত আছে মানুষে মানুষে ব্যাপক বৈষম্য। উন্নত শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি আমরা। এ সময়ে যদি বৈষম্য বাড়তে থাকে, তা হলে কিন্তু রাজনৈতিক শৃঙ্খলাও আঘাতপ্রাপ্ত হবে।

প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে ভরসা আছে। এদেশে মানুষের শক্তির একটা নিজস্ব চাপ রয়েছে। চাপ আছে শান্তি আর স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও। তাই পেট্রোল বোমা দিয়ে মাসের পর মাস সহিংসতা করে, মানুষকে পুড়িয়ে যেমন প্রবৃদ্ধির চাকা থামানো যায়নি, তেমনি বিদেশি হত্যা করে, শিয়া-সুন্নি বিভেদের প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করেছে মানুষই।

দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আবার প্রগতির পথে ফিরেছে। এই অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা আর সেই ভরসা তৈরি করেছেন, করে চলেছেন শেখ হাসিনা।

যেকোনো সম্ভাবনায়, যেকোনো ক্রান্তিকালে বাংলাদেশকে ফিরতে হয় একাত্তরে। যদি আমরা সেই উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্নটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্তরিকভাবে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করি, তবে সামনের সময়টা বাংলাদেশের রূপান্তরের কাল।

বাংলাদেশ আবার ফিরবে একাত্তরে যে সময়টায় প্রাণশক্তি সব শ্রেণি-পেশার, ধর্মের, বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক সমন্বয় ও সুসম্পর্ক। এই আত্মার সন্ধানে শেখ হাসিনার সাথে চলতে হবে, আমাদের আজ নতুন করে বলতে হবে, আমাদের পরম ভালবাসার মাতৃভূমিকে একাত্তরের পরাজিত হায়েনাদের কাছে যেতে দিব না। শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি