এমন নয় যে, বাংলাদেশ এর আগে কখনো এতগুলো ম্যাচ হারেনি। এ তো মাত্র কয়েকটা পরাজয়। বাংলাদেশ এমন দল, যাদের বছরের পর বছর ম্যাচ হারার অভিজ্ঞতা আছে। সেই দলের মাত্র গোটা পাঁচেক হারে আমরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়লাম কেন? কেন আমাদের মনে হচ্ছে যে, সবকিছু ধ্বংস হতে চলেছে? কারণ, বাংলাদেশ দলের এমন হতশ্রী রূপ এর আগে খুব বেশি দেখা যায়নি। 

খেলোয়াড়রা মাঠের খেলার চেয়ে মুখে বেশি আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন। মাঠে খেলোয়াড়দের দেখে মনে হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। শরীরী ভাষায় কোনো ইতিবাচক ভঙ্গি চোখে পড়ে না।

একটা দল কতটা উজ্জীবিত, সেটা বোঝা যায় তাদের ফিল্ডিং দেখে। সেই ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ যেন প্রাণশক্তি ফুরিয়ে যাওয়া একটা দল। ক্যাচ মিস হচ্ছে, সাধারণ বলটার জন্য কেউ ডাইভ দিতে পারছেন না। সবমিলিয়ে এটা যেন হতোদ্যম একটা দল। 

খেলোয়াড়রা মাঠের খেলার চেয়ে মুখে বেশি আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন। মাঠে খেলোয়াড়দের দেখে মনে হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই।

কিন্তু কারণটা কী? কারণ খুঁজতে গেলে আমরা দেখব, এই দলটার আসলে গোড়ায় গলদ আছে। হ্যাঁ, গোড়া বলতে একেবারে বিসিবির টপ ম্যানেজমেন্টের কিছু সমস্যা তো আছেই। তবে সেই সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে আমরা শুধু জাতীয় দলের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আলাপ করতে গেলে দেখব, সেখানেও শুরুতে সমস্যা।

প্রথমত, এই দল যারা পরিচালনা করছেন, তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলা যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কয়েক বছর আগে কোচ নির্বাচনের জন্য চুক্তি করল গ্যারি কার্স্টেন (Gary Kirsten)-এর সাথে। তিনি নিজে কোনো দায়িত্ব না নিলেও বাংলাদেশের কোচ বাছাইয়ের ব্যাপারে তার একটা বড় ভূমিকা থাকে। ফলে বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ হয়ে উঠেছে মাশরাফি বিন মুর্তজার ভাষায় ‘দক্ষিণ আফ্রিকান পুনর্বাসন কেন্দ্র’। 

দক্ষিণ আফ্রিকার এই কোচরা বাংলাদেশকে সত্যিকারের কোনো পথ দেখাতে পারছেন না, এটা পরিষ্কার। এর মধ্যে রাসেল ডমিঙ্গো (Russell Domingo) একটা শর্টকাট বেছে নিলেন নিজের চাকরি টেকানোর জন্য। তিনি বুঝতে পারছিলেন, একটা দুটো সিরিজ জিতে দেখাতে পারলে তার চাকরির মেয়াদ বেড়ে যাবে; ইম্প্রেশন ভালো হবে। 

সিনিয়র খেলোয়াড়রা অতি অল্পেই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আবার বোর্ডের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অধিনায়কসহ সিনিয়র খেলোয়াড়দের আক্রমণ করে কথা বলা হচ্ছে। 

তাই আবারও পরীক্ষিত পুরনো একটা পথ ধরলেন তিনি। মিরপুরে ধীর গতির ও নিচু বাউন্সের নিম্নমানের উইকেট বানিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে সিরিজ হারালেন। এর ফলে ডমিঙ্গোর চাকরির মেয়াদ বাড়ল এবং বাকি কোচরাও দিব্যি স্বস্তিতে রইলেন। কিন্তু তখনই বারবার বলা হলো যে, এভাবে এই উইকেটে জিতে যে ‘ফলস-কনফিডেন্স’ তৈরি হলো, তা আসলে কোনো কাজে আসবে না। 
কাজের বেলায় ঠিক তাই দেখা গেল। বিশ্বকাপ প্রথম পর্বে আমরা স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও হারলাম। এরপর সুপার টুয়েলভ পর্বে এখনো পর্যন্ত সবগুলো হার এবং হার। 

প্রধান কোচের এই সীমাহীন ব্যর্থতার সাথে ফিল্ডিং কোচ ও ব্যাটিং কোচের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। বেসিক জিনিসই তারা করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না। এর সাথে যোগ হয়েছে সিনিয়র খেলোয়াড়দের এবং বোর্ডের দায়িত্বহীন আচরণ।

সিনিয়র খেলোয়াড়রা অতি অল্পেই প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আবার বোর্ডের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অধিনায়কসহ সিনিয়র খেলোয়াড়দের আক্রমণ করে কথা বলা হচ্ছে।

একটা সাধারণ জিনিস হলো, করোনার সময় বলে প্রতিটি দল মূল স্কোয়াডের সাথে ৫-৭ জন রিজার্ভ খেলোয়াড় নিয়ে গেছে বিশ্বকাপে। আমরা টাকা খরচের ভয়ে বা কোনো কারণে সেটা করতে করলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের তিনজন খেলোয়াড় ইনজুরিতে। ফলে স্কোয়াডের বাইরে খেলোয়াড় থাকাটা খুব জরুরি ছিল। 

আমরা জানি, বোর্ড পরিচালকরা হয়তো নিজের পয়সাতেই আরব আমিরাত গেছেন। কিন্তু গ্যালারিতে এক গাদা পরিচালকের বিপরীতে ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় স্বল্পতা দেখতে ভালো লাগার কথা নয়। এমনই সব অসংগতিতে ভরে গেছে এখন ক্রিকেট। 

একটা সোজা কথা বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেট ঠিক সঠিক রাস্তায় চলছে না। সেজন্য হয়তো সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। এখনই এই খাদে পড়ে যাওয়া ক্রিকেটকে টেনে রাস্তায় তোলা না গেলে এরপর হয়তো অতল খাদে চলে যাবে এই ট্রেন। তখন আর টেনে তোলার উপায়ও থাকবে না।

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ।। এডিটর ইন চিফ, খেলা ৭১