ভাষা ও রাজনীতির সম্পর্ক ভীষণ গভীর। ভাষাকে বলা যায় জগৎ নির্মাণের মাধ্যম; সংস্কৃতি বলতে যা কিছু আমরা বুঝে থাকি তার মর্ম গঠিত হয় ভাষাসূত্রে। আর তাই কোনো জাতি, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তিকে বুঝতে চাইলে সবার আগে বুঝতে হয় ভাষা।

বাংলাদেশের মতো জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাষা; ভাষা শুধু ভাষা নয়, বাঙালির জন্য যেন বিশেষভাবে ভাষাই সংস্কৃতি, ভাষাই রাজনীতি। বাঙালি জাতি গঠনের ঐতিহাসিক পরম্পরা তা-ই বলে। এই পরম্পরায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চকিতে উঠে আসা যেকোনো নামমাত্র নয়। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। 

১৯৪৭-উত্তর রাজনীতিতে চমৎকার একটি ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন তিনি। পাকিস্তান গণপরিষদে ছুঁড়ে দিলেন একটি প্রশ্ন, কী হবে রাষ্ট্রের ভাষা? ৬ কোটি ৯০ লক্ষ নাগরিকের দেশে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ নাগরিক বাঙালি, কথা বলে বাংলা ভাষায়। আর তাই রাষ্ট্রভাষাও হওয়া উচিত বাংলা।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বুঝিয়েছিলেন, বাংলা হতে পারে পাকিস্তানের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ (Lingua Franca)। যৌক্তিক একটি ভাষা-বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য বিতর্ক বহু আগেও ছিল; সম্ভাব্য পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতিকে উর্দু ও মুসলামকেন্দ্রিক করার ঝোঁক ছিল। ক্ষমতার উচ্চতম সিঁড়িতে থাকা উর্দুভাষী আশরাফ মুসলমানরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চেয়েছিলেন উর্দুকে। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ইসলাম ও মুসলমানের পরিচিতি।

ভাষা শুধু ভাষা নয়, বাঙালির জন্য যেন বিশেষভাবে ভাষাই সংস্কৃতি, ভাষাই রাজনীতি। বাঙালি জাতি গঠনের ঐতিহাসিক পরম্পরা তা-ই বলে। এই পরম্পরায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চকিতে উঠে আসা যেকোনো নামমাত্র নয়। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। 

কিন্তু পরিচিতি এক নয়, বহু। তার প্রমাণ পেতে শুরু করল পাকিস্তানবাদী বাঙালি মুসলমান। দেখতে পেল ধর্মীয় সংস্কৃতি কিছুটা কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও উর্দুবাদীদের জীবনযাপনের বড় অংশ আলাদা। আর এও দেখল যে, ভাষা ও জাতিগত পরিচয়ই হয়ে উঠল বৈষম্যের মুখ্য কারণ।

অর্থনৈতিক বৈষম্য রাষ্ট্রীয় পরিসরে তৈরি করল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য। এ কারণে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলে গেল শ্রেণি সংঘাত। পূর্ব বাংলার বাঙালি মনস্তত্ত্বে শোষণ থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটি ভেসে গিয়েছিল পাকিস্তানবাদের জোয়ারে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষা বিতর্ক সেই জোয়ারে প্রথম রাষ্ট্রনৈতিক বাধা। কারণ গণপরিষদের মঞ্চে প্রথম উচ্চারিত হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ভাষার প্রসঙ্গ।

রাজনীতিক হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ ভাষার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক যথার্থভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে রাজনীতি ও অর্থনীতি। এ দুটো বিষয় যদি ভাষাকে আঘাত করে তাহলে ভাষার ভেতর দিয়েই এগিয়ে আসতে পারে জনতার প্রতিরোধ।

পূর্ববাংলায় তা-ই ঘটল। সংস্কৃতির মর্মমূলে আঘাত লেগেছিল বলে জন্ম নিল একুশ। যা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় একটি সংখ্যা মাত্র নয়। বাঙালির জন্য বিশাল ঐতিহাসিক স্তম্ভ। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্থাপন করেছিলেন যার রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তি। এর মূল্য তাকে দিতে হয়েছিল।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে আশি অতিক্রান্ত এই প্রৌঢ়কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি হিন্দুর জন্য জাতীয়তাবাদী এ লড়াইয়ে নেমেছিলেন? হিন্দুর জন্য বাড়ির উঠোনে উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা? নাকি নেমেছিলেন জনতার বহুরৈখিক পরিচয়ের একটি পরিচয়কে সামনে রেখে? সেটি কী? নিশ্চয়ই সেটি বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তা। ভাষার পরিচয় সামনে নিয়ে আসার লড়াইয়ে অনিবার্য তার নাম। যদিও তার প্রসঙ্গে জনবিস্তৃত ও ব্যাপকতর মূল্যায়নের ঘাটতি আছে বলেই মনে হয়।

রাজনীতিক হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সমাজ ও সংস্কৃতি প্রখরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই নজির পাওয়া যায় তার আত্মকথায়। বাংলা অঞ্চলের রাজনীতির বড় দুটি পর্ব—ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব বেশ চমৎকারভাবে উঠে এসেছে সেই লেখায়।

আরও দুটি কারণে তাকে মনে রাখতে হবে। এক, তার ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ; দুই, তার জনমুখী রাজনীতি। পূর্ব বাংলার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে ভাবা হয় বলে, অনেক ক্ষেত্রে তার পাকিস্তান পূর্ব রাজনৈতিক অধ্যায়টি কম আলোচিত হয়ে থাকে। অথচ এ পর্বেও উজ্জ্বল তিনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে তার অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরে তিনি ছিলেন জনতার পাশে। 

পাকিস্তান আমলে মন্ত্রী হয়েছেন তিনি। মন্ত্রিত্ব গ্রহণের মুহূর্ত মনে করে তিনি তার আত্মকথায় লিখেছিলেন, ‘আমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিলাম। বস্তুত যেকোনো দেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা, বিশেষ করিয়া অনুন্নত দেশের, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই নহে।’ এই চেতনা অনেক ক্লাসিক বাঙালি রাজনীতিকের মৌল লক্ষণ। আজকের বাংলাদেশে এ লক্ষণ খুঁজে পাওয়া ভার। ক্ষমতার সাথে জনসেবার সম্পর্ক আজ ক্রমশ বিলীন। 

রাজনীতিক হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সমাজ ও সংস্কৃতি প্রখরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই নজির পাওয়া যায় তার আত্মকথায়। বাংলা অঞ্চলের রাজনীতির বড় দুটি পর্ব—ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব বেশ চমৎকারভাবে উঠে এসেছে সেই লেখায়।

বাংলা অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে পারে তার এই বই। চল্লিশের দশকের কথাকার শওকত ওসমান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মজীবনী রচনার ঘটনাকে বলেছেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য’; সত্যিই সৌভাগ্য বলে মানতে হয়। রাজনীতিকদের চিন্তার উৎস উপকরণ এসব বই। মাঠ গরম করা চটুল বক্তব্যের চেয়ে যা তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কিংবা হাল আমলে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর চীন সফর বিষয়ক স্মৃতিকথা ‘আমার দেখা নয়াচীন’।
জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তরা এসেছিলেন; তাদের কাছে বাস্তব দেশ কেবল বাস্তব নয়, অন্য এক কল্পিত ভূ-ভাগ। সেবা দিয়ে দেশকে তারা পূর্ণ করে তুলতে চাইতেন। দেশ সেবাকে মনে করতেন পুণ্যতম কাজ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে উদ্ভূত দেশ চেতনা তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। আজকের এই উত্তর আধুনিক বিশ্বে জাতীয় চেতনার মূল্য কমেছে। বিশ্বায়নের গোলকধাঁধায় আচ্ছন্ন আমাদের চোখ। কিন্তু জাতীয় ইতিহাসকে স্বচ্ছ করে নিতে চাইলে দেখতে পাব ধীরেন্দ্রনাথ দত্তরা খুব নিবিড়ভাবে জানান দিচ্ছেন, তারা ছিলেন। ইতিহাসের অন্ধকার সুড়ঙ্গে এখনো আলোর রেখা তারা।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়