ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল চার। মুক্তিযুদ্ধের ভাসা ভাসা স্মৃতি আছে মনে। সাইরেন বাজলেই দৌড় দিতাম। দোতলা থেকে নিচে সিঁড়িঘরে আশ্রয় নিতাম। বাসার সব কাঁচের জানালায় টেপ দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেওয়া। সবসময় রাস্তার দিকের ঘরগুলোর লাইট নিভিয়ে রাখা হতো।

যেদিন দেশ স্বাধীন হলো সেদিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে। বাসার সামনের চওড়া রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি লাইন করে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে শুকিয়ে যাওয়া কাদামাখা কিছু মানুষ, বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা। তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে আনন্দে।

একটু পরপর ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ চিৎকার। সেই উল্লাসে আমরা সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীনের ঘোষণা শোনার পর আমার বাবা প্রথম যে কাজটা করেছিলেন তা হলো, আমাদের সবাইকে ছাদে নিয়ে লাল সবুজের পতাকা ওড়ানো।

এই আমার স্বাধীনতার প্রথম স্বাদ। বয়স বাড়ল আমার, দেশ ৫০ বছর পেরিয়ে ৫১ তে পড়তে যাচ্ছে। প্রশ্ন আমারও, যারা এদেশের জন্য শহীদ হলেন তারা কেমন দেশ চেয়েছিলেন? গত ১০/১৫ বছর আগেও এই দেশে পাকিস্তানপ্রেমী মানুষের উল্লাস দেখিনি কোনোদিন, এখন দেখছি। কেন? এই প্রশ্ন করা কি অযৌক্তিক হবে? 

গত ৫০ বছরে পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি আমরা এই প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে। এই দায় সবার, তবে দেশ যারা দেখছেন তাদের এই ব্যাপারে জবাবদিহি কোথায়?

যারা এদেশের জন্য শহীদ হলেন তারা কেমন দেশ চেয়েছিলেন? গত ১০/১৫ বছর আগেও এই দেশে পাকিস্তানপ্রেমী মানুষের উল্লাস দেখিনি কোনোদিন, এখন দেখছি। কেন?

অতীত না জানলে দেশ আগাবে কীভাবে? উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেদের শেকড়ের খোঁজও জানা জরুরি। একটা দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সেই দেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে বিশাল ভূমিকা রাখে। দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখার অবিরত চেষ্টা করা মানুষগুলো বোধ করি একাত্তরেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

এখন আর সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কারো বিকার দেখি না। উনারা এখন নিজেদের পকেট ভারী করতে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। শহীদ মিনারে দিনভিত্তিক কিছু জ্বালাময়ী বক্তৃতা আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিষয়ভিত্তিক নিয়মিত টকশো’তে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশোদ্ধার চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।  

আমি বিশ্বাস করি যে, যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো কাজ করে গেলে একত্রে দেশের জন্য সমুদ্রসম কাজ হয়ে যায়। শিল্পী হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করার অবিরত চেষ্টা করি।

২০১৫ সালে অমি রহমান পিয়ালের কথায় ‘পিতা’ নামের গানটি উৎসর্গ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশ্যে। যে গান প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের ওয়েব পেইজে কমেন্ট এসেছে, ‘এরা আওয়ামী লীগ করে এদের গান আর শোনা যাবে না।’ অথচ যারা জাতির জনককে মাথায় করে জীবনযাপন করেন তাদের কাছ থেকে এই গানের বিষয়ে আজ পর্যন্ত কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া আমি পাইনি।

দ্বিধা হয় এখন, অনেক কিছুর সাথে বলার অধিকারও হারিয়েছি মনে হয় মাঝে মাঝে। পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে খেলার মাঠে আস্ফালন করা প্রজন্ম কবে তৈরি হলো এদেশে?

১৫ আগস্ট শোক দিবসের অনুষ্ঠানগুলোতে মাইকে অদ্ভুত সব গান বাজানো হয়, অথচ ‘পিতা’ গানটি বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় বাজবার কথা ছিল। ‘পিতা’ গানটি ছিল জাতির জনককে হত্যার প্রতিবাদ এবং তার দেখানো পথে স্বাধীন দেশে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে চলবার আহ্বান। তাই তো সুরে সুরে গেয়েছিলাম—

‘...পিতা ঘুরছে তোমার হাজার ছেলে 
ক্রোধে শকুন দু’চোখ রাখছে মেলে
তরল সিসা উগড়ে দেব তপ্ত কঠিন 
রক্তেরই রঙ লাল শুধু হয়, হয় না রঙিন...’

দ্বিধা হয় এখন, অনেক কিছুর সাথে বলার অধিকারও হারিয়েছি মনে হয় মাঝে মাঝে। পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে খেলার মাঠে আস্ফালন করা প্রজন্ম কবে তৈরি হলো এদেশে?

জীবনের প্রথম ভোট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলকে দিয়েছি, তারা কী করছেন? উনারা দেখছেন না ধীরে ধীরে আমরা কোথায় হারাচ্ছি? হায়! তাদের কাছে এই অশালীন আস্ফালন রুখবার জন্য দাবি জানাতে হবে?

স্বাধীনতার যে লাল সবুজ পতাকা আমার বাবা উড়িয়েছিলেন সেই পতাকা আজ খামচে ধরেছে পিশাচের দল। এদের রুখে দেওয়ার এখনই সময়, সময়ে সাধন করুন।

সাইদ হাসান টিপু ।। সংগীতশিল্পী