ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। একতলা বাসা। সামনে ছোট্ট লন, সবুজ ঘাস। গেট দিয়ে ঢুকবার সাথে সাথে বিড়ালদের সাথে সাক্ষাৎ শুরু। লন পেরিয়ে, বারান্দা, ড্রয়িংরুম তারপর বেডরুম। ঘরে আর বাইরে সব জায়গাতেই তাদের রাজত্ব। বেডরুমে সাদা বিছানার চাদরে ধবধবে সাদা শাড়িতে বসে থাকতেন বিল্লী নানু, মায়ের প্রিয় বন্ধু লুলু খালার মা। তার চারিদিকে বিড়ালের আড্ডা।

সেই ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে সেই বাসায় যখন যেতাম তখনো জানা হয়নি যে, তিনি পঞ্চাশ দশকে ভাষা আন্দোলনের সহযাত্রী, পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম নারীশিক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ, ষাট দশক থেকে বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল তরুণ সমাজের মুরব্বি, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বটবৃক্ষ, স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের আশ্রয়স্থল, রাজাকার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়কের একজন, সবার প্রিয় কবি সুফিয়া কামাল।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়ে এই উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। বনেদি শিক্ষিত পরিবারের নারীরা ঘরে বসেই শিক্ষা নিতেন। তিনি গৃহশিক্ষাতেই বাংলা, হিন্দি, উর্দু এবং আরবি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অথচ নারীবান্ধব ডিজিটাল যুগে আমরা তার মতো শিক্ষানবিশ হয়ে উঠতে পারিনি।

১৯১৮ থেকে ১৯২৬ সাল তার জীবনে আলোর পথে হাঁটবার সুযোগ করে দিয়েছিল। ’১৮ সালে মায়ের সাথে কলকাতা ভ্রমণে গেলে বেগম রোকেয়ার সাক্ষাৎ পান। সে সময়ে বেগম রোকেয়া মুসলিম নারীশিক্ষা এবং অধিকার নিয়ে কাজ করছিলেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় সুফিয়া কামালকে কবি হিসেবে তুলে ধরা হয় সওগাত ম্যাগাজিনে ‘বাসন্তী’ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৩১ সালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান উইম্যান ফেডারেশন’ এ প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে সদস্য পদ লাভ করেন।

মহাত্মা গান্ধীর সাহচর্যে সুফিয়া কামাল সহজ জীবনযাপন এবং সাধারণ পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। যা তিনি তার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করেছেন। ১৯৪৭ সালে ‘বেগম’ পত্রিকায় তিনি উদ্বোধনী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাকে থামানোর জন্য শান্তির বার্তাসহ বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি ঢাকা আসেন এবং পিস কমিটিতে যোগ দেন।

আমার মা সারা মাহমুদ গল্প বলেন, ষাট দশকের পর থেকে আমার বাবা শহীদ আলতাফ মাহমুদের লোকাল গার্ডিয়ান ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। বাবা মায়ের বিয়ের প্রথম কথা এবং বিবাহ সম্পন্ন তার মাধ্যমেই হয়েছিল।

তার পরের বছরই ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা কমিটি’র চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সাথে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েন। এরপর থেকে রাজপথের আন্দোলনে তিনি কখনো থেমে থাকেননি। সে সময়ের প্রগতিশীল, রাজনীতি সচেতন তরুণ সমাজের মাঝে আপন স্বজন হিসেবে নিজস্ব অবস্থান পোক্ত করেন।

আমার মা সারা মাহমুদ গল্প বলেন, ষাট দশকের পর থেকে আমার বাবা শহীদ আলতাফ মাহমুদের লোকাল গার্ডিয়ান ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। বাবা মায়ের বিয়ের প্রথম কথা এবং বিবাহ সম্পন্ন তার মাধ্যমেই হয়েছিল।

বিশেষ করে বাবার মতো অন্য জেলা থেকে আসা তরুণেরা যখন দেশের কাজ করছেন, ঢাকায় পরিবার স্বজন না থাকলেও সকলের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রেখেই তিনি সবার খালা হয়ে এসব কাজ করতেন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ আন্দোলনে আবারও সুফিয়া কামাল সোচ্চার হয়ে ওঠেন। শিশু কিশোরেরা যেন খেলাঘরে নিয়মিত সাংস্কৃতিক পরিবেশে যেতে পারে সে কারণে নিজের সন্তানসহ ঢাকায় অবস্থিত সংস্কৃতিমনা পরিবারগুলোর সন্তানকে একসাথে করতেন।

১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময় তিনি ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ তৈরি করেন এবং তার নেতৃত্বে রাজপথ জনপদে সব ধরনের সংগ্রামী আন্দোলনে বা মিছিলে নারীদের যোগদান নিশ্চিত করতেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কবি সুফিয়া কামাল দেশের সকল শ্রেণির নারী অধিকার আদায়, প্রতিষ্ঠা এবং আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য গঠন করেন ‘মহিলা পরিষদ’। এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে তিনি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন।

এক সভায় বাঙালিদের পশু বলে আখ্যা দেন আইয়ুব খান। তার উত্তরে সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, আমরা যদি পশু হই তাহলে আপনি পশুদের রাজা।

বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধ উত্তরকাল এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সুফিয়া কামালের পদচারণা ছিল শক্তিশালী এবং উচ্চকণ্ঠী। সে সময়ে সোশ্যাল এলিট গ্রুপের পক্ষে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখতেন। এমন কি আইয়ুব খানকেও সরাসরি কথা শোনাতে ভীত হতেন না। এক সভায় বাঙালিদের পশু বলে আখ্যা দেন আইয়ুব খান। তার উত্তরে সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, আমরা যদি পশু হই তাহলে আপনি পশুদের রাজা।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গণহত্যা সংঘটিত হয়নি বলে একটি ঘোষণায় তাকে মেরে ফেলার ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক সাক্ষর দেওয়ার জন্য বলা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি আমার জীবনের পরোয়া করি না। শত্রুর মিথ্যা বয়ান স্পর্শ করবার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়।

সুফিয়া কামাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় অবস্থান করেন এবং ঢাকার গেরিলা যোদ্ধারা প্রত্যেকেই তার পূর্ব পরিচিত হওয়ার কারণে তিনি শক্ত হাতে তাদের সাহায্য করতে থাকেন। পারিবারিক বন্ধুতা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আরও গাঢ় হয়েছিল।

ঢাকায় গেরিলা আক্রমণে সক্রিয় ছিল আমাদের দুর্গবাড়ি, ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড। এই বাড়ি থেকে নিয়মিত যোগাযোগ চলত তখন। সুফিয়া কামালের দুই কন্যা লুলু এবং টুলু মেলাঘরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মেডিকেল টিমে যোগদান করেন। তাদের কাছে নিয়মিত মেডিকেল সাপ্লাইয়ের মতো জরুরি জিনিস, চিঠি, তথ্য পাঠানো হতো, এই বাড়ি থেকে। তিনি নীরবে এসব জোগাড় করতেন। শত্রুপক্ষের কঠিন চোখের আড়ালেই চলতো এসব কাজ।

কবি সুফিয়া কামাল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শুধু নারী আন্দোলনেই সোচ্চার থাকেননি, শহীদ পরিবার এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছেন, সবসময়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সাথে যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবি আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সদা সক্রিয়।

একজন সুফিয়া কামালকে জানতে হলে, তার কথা বলতে গেলে শিহরিত হতে হয় বারবার। একেবারে নারীবান্ধব বর্জিত সমাজে নারী অধিকার আদায়ে সুদীর্ঘ আন্দোলন করার মতো মানুষ হিসেবে, ইতিহাসে তার নাম উচ্চারিত হয় বারবার। তরুণ সমাজকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করার জায়গায়ও তাকে দেখা যায়।

দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ভূমি রক্ষা আন্দোলনেও তার শক্তিশালী পদচারণা এখনো শুনতে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষে থাকা সকলের পাশে কবি সুফিয়া কামালকে দেখা যায়।

আজ এত বছর পর, শ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালের স্মরণে লেখার সময় প্রতিটা শব্দে মাথা নত করছি, শ্রদ্ধায়, বারবার। নারী মুক্তি আন্দোলনে সদা সোচ্চার মানুষটির কাছে লজ্জিত হয়েছি, তার মতাদর্শের ধারা ধরে রাখতে পারিনি একটুও আমরা।

শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা