ভোজ্যতেলের বাজারে রীতিমতো চলছে চরম নৈরাজ্য। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাব অনুসারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়াল।

নতুন দর অনুযায়ী, বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেল কিনতে লাগবে ১৬৮ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতলে খরচ হবে ৭৯৫ টাকা। এতদিন এক লিটার বোতল ১৬০ টাকায় এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৭৬০ টাকায় পাওয়া যেত। এছাড়া পাম তেলের প্রতি লিটারের দাম ছিল ১১৮ টাকা। এখন পাম তেলের দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৩ টাকা।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি টন ৮২৫ ডলার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩২২.২৫ ডলারে। অর্থাৎ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বরাবরের মতো রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ব্যবসায়ীরা। আর বাড়তি দাম বহনে করোনা মহামারির মধ্যে আরও পিষ্ট হবে প্রান্তিক, শ্রমজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষ।

ভোজ্যতেল ধনীদরিদ্র থেকে শুরু করে দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম যেভাবে বেড়েছে দেশে তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি টন ৮২৫ ডলার। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩২২.২৫ ডলারে। অর্থাৎ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম অয়েলের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ।

অপরদিকে টিসিবির তথ্যমতে, এই সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে পাম তেলের দাম বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে খোলা পাম তেলের লিটার বিক্রি হয়েছে ৭৩ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৩৬ টাকায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে পাম তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে ২৭ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়েছে। একই সময়ে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ৫৬৪ ডলার থেকে বেড়ে ১৪৪০ ডলার হয়েছে। অর্থাৎ দাম বেড়েছে ৬৪ শতাংশ।

অপরদিকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ৯৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে এ তেল বিক্রি হয়েছিল লিটার ৮৫ টাকায়। যা এখন দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৮ টাকা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়েছে।

গত জানুয়ারি মাসে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে আট টাকা বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল ওয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন। তখন ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাম বাড়ানো যাবে না বলে ব্যবসায়ীদের জানিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু পরের দিনই বাজারে উল্টো চিত্র প্রতি লিটারে ৩-৪ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হলো, ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা গত মাস থেকে দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সেই সময় তাদের বলা হয়েছিল ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাম বাড়ানো যাবে না। এর মধ্যে দর বাড়ানোর বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী আজ দর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১৯ অক্টোবর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে পাইকারি বাজারে মণ প্রতি খোলা সয়াবিনের পাইকারি দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা। ওই সময়ে পাইকারি পর্যায়ে পাম অয়েলের দাম ছিল মণ প্রতি প্রায় ২ হাজার টাকা। অথচ দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশের বাজারে পণ্য দুটির দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিগত দুই বছরের ব্যবধানে দেশে ভোজ্যতেলের দাম অন্তত ২০ দফায় বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ এক বছরে ভোজ্যতেলের বাজার ব্যবসায়ী ও সরকারি যৌথভাবে বেড়েছে ১০ বার।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকেই ভোজ্যতেলের পাইকারি বাজার আবার অস্থির হয়ে ওঠে। প্রায় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম মণ প্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) বেড়েছে প্রায় ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। সরকারিভাবে দাম বাড়ানো না হলেও ট্রেডিং বাণিজ্যের কারণে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিও লেনদেনের মাধ্যমে দাম আগে থেকেই বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিন সপ্তাহ আগেও পাইকারিতে মণপ্রতি পাম অয়েলের দাম ছিল ৫ হাজার ১০০ থেকে ৫ হাজার ১৫০ টাকা। অন্যদিকে সুপার পাম অয়েলের দাম মণ প্রতি ৩০০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ টাকায়। এছাড়া সয়াবিনের দাম মণপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে লেনদেন হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায়।

ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এক মাস আগে ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর আবেদন করেন। এক মাস আগের এবং বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। আমদানিকারকরা এখন যে ভোজ্যতেল বিক্রি করছেন, তা অনেক কম দামে কেনা। আর এর মধ্যে আর্ন্তজাতিক বাজারে অনেকবার ভোজ্যতেলের দাম উঠানামা করেছে। বাংলাদেশের বাজারে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাছাড়া যে সভায় দাম নির্ধারণ হয় সেখানে ভোক্তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাই সেখানে ভোক্তাদের মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগও ছিল না। তাছাড়া যখন তেলের দাম কমে যায় তখন তারা আর দাম কমায় না। সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তেলের দাম না বাড়িয়ে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। কিন্তু তা না করে উল্টো ভোক্তার ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট থেকে ভোজ্যতেলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ শুরু হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে ওই দামের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট ও কর আদায় করলে স্থানীয় বাজারেও দাম বাড়ে।

ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা বারবার বলছেন, ব্যবসায়ীরা বারবার আর্ন্তজাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ান। আর্ন্তজাতিক বাজারে যে পণ্যটির দাম বেড়েছে তা বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে কমপক্ষে ২-৩ মাস সময় লাগবে। আর আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম কমলে তারা আবার বলেন বেশি দামে কেনা। তাই আগের দামে কেনা হলেও শুধু ঘোষণার কারণেই বাড়তি দামে বিক্রি করে এক দিনে ব্যবসায়ীরা লুটে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। করোনা ও অমিক্রনের কারণে অধিকাংশ মানুষ আয় রোজগার হারিয়ে পর্যুদস্ত। সেখানে, যারা দাম বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন, তারা কি একবারও চিন্তা করেছেন, দেশের মানুষের এত চড়া দামে ভোজ্যতেল কেনার সামর্থ আছে কিনা?’

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ব্যবসায়ীরা দাবি জানাচ্ছে, আর সরকার দফায় দফায় দাম বাড়ানোর অনুমতি দিচ্ছেন। দেশের সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবছে না। সরকারও দেশের মানুষের কথা চিন্তা না করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছে। বিগত বছর-দু’এক ধরে দেশের বাজারে দফায় দফায় যে হারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, বিশ্বের কোনো দেশে এভাবে এত দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এবার যে হারে বাড়ানো হলো তাতে দেশের মানুষের সঙ্গে অন্যায্য কাজ করা হলো।

দেশের ভোজ্যতেলের সিংহভাগ যোগান মূলত স্থানীয় বাজারে পুষ্টি ব্র্যান্ড নামে সরবরাহকারী টিকে গ্রুপ, তীর নামে সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের তেল সরবরাহকারী বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড তারা যেভাবে চাচ্ছে মূলত সেভাবে দেশীয় বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। সেকারণে এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রেগুলেটরি ভূমিকা সেভাবে দৃশ্যমান নয়। যার কারণে দেশে ন্যায্য ব্যবসার পরিধি ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে পণ্য সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি, যোগসাজশে ও সিন্ডিকেট করে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা প্রতিটি পণ্যের বাজারে সংক্রমিত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং ট্যারিফ ও ট্রেড কমিশন নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের অস্থিত্ব থাকলেও কার্যত তারা অন্য বিষয়ে ব্যস্ত। ফলশ্রুতিতে দেশের ভোক্তারা অসহায় ও তাদের পক্ষে কথা বলা লোকের সংখ্যাও দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে।

কোম্পানিগুলো মতে, বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ও অস্থিতিশীল হবার কারণ হিসেবে ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) চার স্তরের হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের আমদানি মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাটের চাপও বেশি পড়ছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেট থেকে ভোজ্যতেলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ শুরু হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে ওই দামের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট ও কর আদায় করলে স্থানীয় বাজারেও দাম বাড়ে।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা অবস্থা উত্তরণে ভোজ্যতেল আমদানিতে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে তার ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করার প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, আমদানি মূল্যের ওপর ভ্যাট আরোপের পরিবর্তে টনপ্রতি দাম নির্দিষ্ট করে দিয়ে ওই দামের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও করের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। এতে করে ভোক্তাদের অতিরিক্ত করের বোঝা টানতে হবে না।

এছাড়াও ভারত সরকার ভোজ্যতেল আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরই মধ্যে সাড়ে ৭ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে। আগে যেখানে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ ছিল, সেখানে মাত্র আড়াই শতাংশে ভোজ্যতেল আমদানির সুযোগ পাচ্ছে ওই দেশের ব্যবসায়ীরা। যার কারণে ভারতে ভোজ্যতেলের বাজার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আবার ব্যবসা বাণিজ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও সুস্থ পরিবেশ তৈরি করার জন্য হাতেগোনা ২/৪টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যদের ভোজ্যতেলের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি দরকার। গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী যেন পুরো নিত্যপণ্যের বাজারে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনকে সক্রিয় হতে হবে।

একই সাথে বাজার তদারকিতে সরকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত নজরদারি বাড়াতে হবে। বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, খাদ্যসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলির নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া রীতি রদ করে ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহল নিশ্চিত করা গেলে ভোক্তাদের প্রতি অন্যায্যতা কমানো সম্ভব।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।