সরকারের নির্বাহী আদেশে কারামুক্ত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার বড় কোনো পরিবর্তন নেই। ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন পুরোনো রোগে এখনও ভুগছেন তিনি। তবে তার শরীরের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি লিভার সিরোসিসের সমস্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। অসুস্থতা ও মুক্তির শর্তের বেড়াজালে আটকে থাকায় শারীরিকভাবে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় আছেন তিনি। তবে নিয়মিত দল ও দেশের রাজনীতির খোঁজ রাখছেন বলে জানা গেছে।    

খালেদা জিয়ার চিকিৎসক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা বলছেন, কিছুদিন আগে সিজনাল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বর্তমানে তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে তার শরীরের পুরোনো জটিলতাগুলো এখনও আছে। যতটুকু সম্ভব ওষুধ দিয়ে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে। এখন তার আবারও কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। এজন্য তাকে যেকোনো দিন হাসপাতালে নেওয়া হতে পারে। যদিও হাসপাতালে যেতে তিনি বরাবরই অনাগ্রহী

খালেদা জিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তার বোন সেলিমা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আছে আগের মতোই। তার (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা তো খুব বেশি ভালো নয়। কারণ তার তো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়নি। দেশে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসকরা করেছেন। তার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন, যেটা চিকিৎসক এবং আমরা বারবার বলেছি। কিন্তু সরকার তো অনুমতি দেয় না।

নিয়মিত চেক আপের জন্য চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হতে পারে। তবে দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

তিনি আরও বলেন, মাঝেমধ্যে তার শরীরে জ্বর আসে। আবার সেরেও যায়। খাবার খুব বেশি একটা খেতে পারেন না। আমার নিজের শারীরিক অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়, পায়ে সমস্যা হয়েছে। চিকিৎসকরা সিঁড়িতে ওঠা-নামা করতে নিষেধ করেছেন। এই কারণে তার (খালেদা জিয়া) বাসায় আগের মতো যেতে পারি না।
 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত এক চিকিৎসক বলেন, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমাদের খুব সাবধানে কথা বলতে হয়। সরকার কীভাবে নিচ্ছে তা বিবেচনায় নিতে হয়, আবার সেটা বিএনপির নেতাকর্মীদের মানসিক অবস্থার ওপর কী প্রভাব পড়বে তাও বিবেচনায় নিতে হয়। তাই অনেক সময় চাইলেও আমরা ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র বলতে পারি না। 

তিনি বলেন, এখন ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। দেখার বিষয় হচ্ছে, এই ভালো কতদিন থাকে। কারণ ওনার তো অনেক রোগ। একটার সঙ্গে আরেকটার যোগসূত্র রয়েছে। ফলে কোনো একটা রোগ যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, তখন বাকিগুলো খারাপ হয়ে যাবে। তবে আশার কথা হচ্ছে ওনার লিভার সিরোসিসের যে সমস্যা সেটা এখন ভালো আছে। 

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, নিয়মিত চেক আপের জন্য চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হতে পারে। তবে দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।     

খালেদা জিয়াকে জানানো হয় দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা

সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার শর্তে রয়েছে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারবেন না। তাই গত কয়েক বছর ধরে বিএনপির কোনো সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তবে দলের বড় যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে খালেদা জিয়াকে জানানো হয়। তিনি নিজেও টেলিভিশন ও প্রত্রিকা পড়ে নিয়মিত দল ও দেশের রাজনীতির খোঁজ রাখছেন। কোনো বিষয় নিয়ে নিজের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হলে তা দলের নেতা ও ব্যক্তিগত স্টাফদের কাছ থেকে জেনে নেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র বলছে, ম্যাডামের বর্তমান যে শারীরিক অবস্থা, সেটি বিবেচনায় নিলে এমনিতেই দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হওয়া ওনার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে দলের বর্তমান সাংগঠনিক কার্যক্রমের সবকিছু দেখভাল ও সিদ্ধান্ত নেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ম্যাডাম দলের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো ভূমিকা রাখেন না। কিন্তু দলের যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা ওনাকে জানানো হয়। প্রতিমাসে তিন-চার দিন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওনার সঙ্গে দেখা করে দলের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর বিষয়ে অবহিত করেন। কোনো পরামর্শ নেওয়ার দরকার হলে সেটিও নেন। তিনি নিজ থেকেও অনেক বিষয়ে পরামর্শ দেন। এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে তো নিয়মিত যোগাযোগ হয়। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ম্যাডাম এখনো আমাদের চেয়ারম্যান আছেন। আমাদের স্থায়ী কমিটিতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সবকিছু চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুমোদনেই হয়। বৈঠকে ম্যাডাম অংশ নেন না, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভার্চুয়ালি অংশ নেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপির সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ছাড়া যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে ম্যাডামের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির যে সংলাপ বা মতবিনিময় চলছে, তা ম্যাডামের অনুমতি নিয়েই করা হচ্ছে। তার অনুমতি না থাকলে আমরা কি এটা করতে পারতাম?

তিনি বলেন, চলমান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব আসবে, সেগুলোর সামারি তৈরির পর চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরির আগে আবার ম্যাডামকে দেখানো হবে। তখন ওনার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হবে, কীভাবে কী করা যায়।
 
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনীতিতে ম্যাডাম শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকলেও সব খবরই তিনি রাখেন। নিয়মিত টেলিভিশন দেখেন, পত্রিকা পড়েন। তখন কোনো বিষয়ে কোনো প্রশ্ন জাগলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের কাছ থেকে সেই বিষয়ে জেনে নেন।

এই কর্মকর্তা বলেন, আমি দীর্ঘদিন ম্যাডামের সঙ্গে আছি। এই দীর্ঘসময়ে আমি কোনো বিষয় নিয়ে ওনার মধ্যে কোনো হতাশা দেখিনি। তবে তার মুক্তির দাবিতে দলের আন্দোলন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে দেখেছি। তিনি নিজেই একদিন আমাকে বলেন, ‘এই দলের নেতা-কর্মীদের জন্য আমি কি কিছু করিনি? জিয়ার সময় অনেকে এমপি-মন্ত্রী হয়েছে। আমার সময়ে হয়েছে... অনেককে মন্ত্রী বানিয়েছি। কিন্তু আজ সবাই নিজ-নিজ অবস্থান নিয়ে ব্যস্ত। সবাই (আন্দোলনের চেয়ে) নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত।’          

এএইচআর/জেডএস