প্রায় ৫ মাসের চিকিৎসা শেষে ব্যাংকক থেকে আজ দেশে ফিরেছেন জাতীয় পার্টির চিফ প্যাট্রন ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। তার দেশে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে ফের চাঙা হয়েছেন অনুসারীরা। এমনকি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরপন্থি প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাও অবস্থান পরিবর্তন করে ভিড়েছেন রওশন এরশাদের ছায়াতলে।

অনুসারীদের হঠাৎ বাঁক বদলে জাতীয় পার্টিতে জিএম কাদেরের অবস্থান কিছুটা হলেও দুর্বল হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। এছাড়া হাইকোর্টে মামলা নিয়েও জটিলতায় আছেন তিনি। ফলে ওই শীর্ষ নেতাদের ধারণা, রওশন এরশাদের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার পথে হাঁটবেন জিএম কাদের।

একইভাবে আজ দেশে ফেরার পর রওশন এরশাদের বক্তব্যেও ‘নরম’ সুর শোনা গেছে। তিনি বলেছেন জিএম কাদেরসহ সবার সঙ্গে বসবেন এবং বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি দূর করবেন। ফলে জাতীয় পার্টির দুই পক্ষই আপাতত সমঝোতার দিকে হাঁটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে আজ রোববার জাতীয়পার্টির দুই কো-চেয়ারম্যান এবং তিন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। তাদের বক্তব্যে সমঝোতার আভাসই পাওয়া গেছে। তবে এই সমঝোতা এমনি এমনি নয়, তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপে হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

তারা বলছেন, রওশন এরশাদের হঠাৎ করে সম্মেলন ডাকাকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল তা কেটে যাবে। একই কারণে ভাবি রওশন এরশাদ ও দেবর জিএম কাদেরের মধ্যকার যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল তারও অবসান ঘটতে যাচ্ছে। ফলে জিএম কাদের আগের মতোই দলের চেয়ারম্যান থাকছেন আর রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদে থাকছেন।

তবে দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা এবং সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তাদের দলীয় পদ ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদের সিদ্ধান্ত নেবেন।

রওশন এরশাদকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে যান জিএম কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু।

আরও পড়ুন : আমি দেখে নেব উনি কীভাবে রাজনীতি করেন, জি এম কাদেরকে রাঙ্গা

সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা দলের ঐক্য ধরে রাখব। এটা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও চান। আমাদের দলের ঐক্য আগেও ছিল। কিছু লোক সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। আমি মনে করি, রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরও একই সুতোয় গাঁথা। এখানে কোনো বিভেদ নেই।

রওশন এরশাদের হঠাৎ করে জাতীয় পার্টির সম্মেলন ডাকাকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল তা কেটে যাবে। একই কারণে ভাবি রওশন এরশাদ ও দেবর জিএম কাদেরের মধ্যকার যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল তারও অবসান ঘটতে যাচ্ছে। আর এটা সম্ভব হচ্ছে তৃতীয় একটি পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে।

তিনি আরও বলেন, জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান থাকবেন। রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা থাকবেন। তারা দুজন পরামর্শ করে দল পরিচালনা করবেন। আমি সবসময় দলের ঐক্যের কথা বলে আসছি।

সুনীল শুভ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে বিমানবন্দর যেতে দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের না করেননি,  আবার যেতেও বলেননি। বিমানবন্দরে আমার অন্য একটি কাজও ছিল, আবার ম্যাডামও দেশে এসেছেন। তাই তাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়েছি। ম্যাডাম বিমানবন্দরে নেমে দলের মধ্যে সমঝোতার কথা বলেছেন। এখন হয়ত সমঝোতা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একজন কো-চেয়ারম্যান ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যানের কার্যক্রমে আদালতের হস্তক্ষেপের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। এটা একটা রেকর্ড হয়ে থাকবে। তার মধ্যে এতদিন যেসব নেতা জিএম কাদেরপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, সেই রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা তাদের অবস্থান বদল করে আজ রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তাই এখন জিএম কাদেরের সামনে কেবল সমঝোতার পথই খোলা আছে।

আরও পড়ুন : জাতীয় পার্টিতে ফের ভাঙনের সুর!

তিনি আরও বলেন, আদালত থেকে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি আসলে এখন জিএম কাদের হাইকোর্টে যাবেন। তারপর বোঝা যাবে আসলে জিএম কাদেরের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। আপাতত সমঝোতা করাটাই জিএম কাদেরের জন্য ভালো হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, রওশন এরশাদ যখন প্রথমবার চিকিৎসা শেষে দেশে এসেছিলেন তখন চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ আমরা তাকে বিমানবন্দরে আনতে গিয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় দফায় রওশন এরশাদ আবার চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে যাওয়ার সময়ও বিমানবন্দরে গিয়ে বিদায় দিয়ে আসি। এবারও দলের কিছু প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলীয় সংসদ সদস্যরা রওশন এরশাদকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে গিয়েছেন। এটা তাদের অবস্থান বদল বলে আমি মনে করি না। বিষয়টা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে এমনও নয়, এখানে দোষেরও কিছু নেই। তাছাড়া রওশন এরশাদ এখনও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন।

এই প্রেসিডিয়াম সদস্য আরও বলেন, রওশন এরশাদ বিমানবন্দরে দেওয়া বক্তব্যে জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাকে দলের চেয়ারম্যান মেনে নিলে তো কোনো সমস্যা থাকবে না। তাছাড়া তিনি দলে ঐক্যের ডাকও দিয়েছেন। ফলে গত কয়েক মাসে জাতীয় পার্টির মধ্যে যে মতবিরোধ ছিল সেটার অবসান হতে যাচ্ছে। রওশন এরশাদ আর জিএম কাদেরের মধ্যেকার দ্বন্দ্বেরও শেষ হতে যাচ্ছে।

তাহলে কি জিএম কাদের রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা মেনে নিচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা বলেন, এই বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ এটা দলীয় বিষয়।

প্রসঙ্গত, রোববার দুপুরে থাইল্যান্ড থেকে ফিরে বিমানবন্দরে রওশন এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের সঙ্গে বৈঠকে বসব। আমি ঢাকায় ফিরে এসেছি। সব এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং অন্যান্যদের সঙ্গে বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে বসব। আমি নিশ্চিত, সেই ভুল বোঝাবুঝি দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে শিগগিরই রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ফিরতে পারব।

এএইচআর/এসকেডি/জেএস