রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকার ভিআইপি রোডে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটনা ঘটে বুধবার (৭ ডিসেম্বর)। এ ঘটনায় একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এরই জেরে বিএনপি কার্যালয় থেকে আটক করা হয় শতাধিক নেতাকর্মীকে। এ ঘটনার পর থেকেই নয়াপল্টন এলাকাজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।

এদিকে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে গভীর রাতেও নয়াপল্টনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।

রাত ১টায় ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভিআইপি রোডে আশেপাশের এলাকা থেকে মিলিত হওয়ার গলিগুলো পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। একইসঙ্গে রাস্তাজুড়ে কিছু দূর পরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের বসে থাকতে দেখা গেছে। নিরাপত্তার স্বার্থে ভিআইপি রোডের নাইটেঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত যান চলাচল এখনও বন্ধ রেখেছে পুলিশ।

আরও পড়ুন : আন্দোলনের ডামাডোলে থাকুক শান্তির বারতা 

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্ক অবস্থানে আছেন তারা।

রাতে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতের জন্য আমাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া আছে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যও মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা সব বিষয়ে সর্তক আছি।

বিএনপি কার্যালয় যেন ‘ভূতুড়ে বাড়ি’

রাত সাড়ে ৯টার পর ভিআইপি রোড নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তখন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কার্যালয় একটি ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কেউ যেন একটু আগে এসেই ওলট-পালট করে গেছে ভবনের প্রতিটি কক্ষ।

দেখা গেছে, কার্যালয়ের প্রবেশপথে জিয়াউর রহমানের একটি ভাস্কর্য রয়েছে। সেই ভাস্কর্য যে কাঁচের বক্সে রাখা হয়েছিল, সেটিও ভাংচুর করা হয়েছে। ভাস্কর্যে জিয়াউর রহমানের চোখে যে সানগ্লাস ছিল, সেটির একটি চোখের কাঁচ ভেঙে ফেলা হয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে দেখা গেছে, পুরো ভবনজুড়ে কাগজ, পানির বোতল, লাঠি, কার্টুন পড়ে আছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে সিঁড়িকোঠার জানালার কাচও। দোতলায় ঢুকে একটি রুমের দরজা ভাঙা পাওয়া গেছে। উলট-পালট ছিল ওই রুমে থাকা সব তোশক। রুমটির অর্ধেক জায়গাজুড়ে ছিল পানির বোতল।

ওই তলার আরেকটি রুমে ঢুকে দেখা গেছে, চেয়ার উল্টে পড়ে আছে, রুমের টেবিলে রয়েছে একটি ডেনিম কাপড়ের জ্যাকেট।

আরও পড়ুন : ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা 

তৃতীয় তলায় উঠতেই নাকে ভেসে আসছিল টিয়ারশেলের ঝাঁঝালো গন্ধ। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে চতুর্থ তলায় উঠে দেখা গেছে, টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র রাখা আছে আর রুমটা ছিল অগোছালো। অন্য পাশে গিয়ে দেখা যায়, এলোমেলো পড়ে আছে চেয়ার, কার্টুন, চাটাই। ওই ফ্লোরের আরও একটি রুম ভর্তি ছিল পানির বোতল।

আরও একটি অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে পঞ্চম তলায় উঠতেই দেখা গেছে, দরজার ছিটকিনি ভেঙে পড়ে আছে ফ্লোরে। রুমটির মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বালতি, বালিশ। অন্য আরেকটি রুমে সারিবদ্ধ ভাবে রয়েছে বেশ কয়েকটি চেয়ার। চেয়ারের পেছনে ছিল জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়ার বোর্ডে কাটা কয়েকটি ভাস্কর্য। যেগুলো ওলট-পালট অবস্থায় পড়েছিল। ওই ফ্লোরের অন্য রুমগুলো অগোছালো ছিল।

সর্বশেষ ষষ্ঠ তলায় উঠে দেখা যায়, এখানেও একটি রুমের টেবিলের উপর ওলট পালট করে রাখা হয়েছে অনেকগুলো কাগজপত্র। চেয়ার ভেঙে পড়ে আছে ফ্লোরে।

আরও পড়ুন : সহমতের রাজনীতি

পুরো ৬তলা ভবন ঘুরে আরও দেখা গেছে, রুমগুলোতে জ্বলছিল লাইট, চলছিল এসি ও ফ্যান। ওয়াশরুমের কলগুলো থেকে আসছিল পানি পড়ার শব্দ। অচেনা কোনো ব্যক্তি ওই ভবনে প্রবেশ করলে, ভূতুড়ে বাড়ি ছাড়া কিছুই মনে হবে না।

পড়েছিল পাতিলভর্তি খিচুড়ি

সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নয়াপল্টন কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় বড় বড় কয়েকটি পাতিলে রান্না করা খিচুড়ি পড়ে রয়েছে। পাশের টেবিলে খিচুড়ি ভর্তি কয়েকটি বাক্সও পড়ে রয়েছে। একটু সামনের যেতেই দেখা যায়, বিএনপি কার্যালয় নিচতলায় আটটি বড় পাতিলে রান্না করা খিচুড়ি পড়ে আছে। সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে আরও ১০ থেকে ১২টি বড় পাতিল, সেগুলোতে খিচুড়ি রান্না করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। মূলত এ খিচুড়ি রান্না করা হয়েছিল কার্যালয়ে আসা নেতাকর্মীদের জন্য। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে সেই আয়োজনটিও ভেস্তে যায়।

বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফায় সংঘর্ষের পর নয়াপল্টনের রাস্তাজুড়ে পড়েছিল ইট পাটকেলসহ ব্যানার ফেস্টুন লাঠি সোটা। রাত ১১টার পরে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা সেগুলো পরিষ্কার করা শুরু করে। একইসঙ্গে রাস্তার দুই ধারে ও মাঝখানে লাগানো বিএনপির অসংখ্য ব্যানার ফেস্টুন খুলে ফেলেন তারা।

রিজভীসহ শতাধিক নেতাকর্মী আটক

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনার পর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতর থেকে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী-আমান উল্লাহ আমানসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করে দলটি। 

আরও পড়ুন : রাজনীতি কি মরণ খেলা? 

বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য বিএনপি কার্যালয়ে প্রবেশ করে তাদের বের করে নিয়ে আসে। পরে রিজভীসহ অন্যদের পুলিশ ভ্যানে তুলে নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

এ ঘটনার পর তাৎক্ষণিক দলীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানের বিষয়ে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

তিনি বলেন, বিএনপি অফিসে তাণ্ডব চালিয়েছে পুলিশ। তারা বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে গেছে।

আরও পড়ুন : জনপ্রতিনিধি নাকি জনপ্রিয় প্রতিনিধি? 

এদিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। মকবুল হোসেন নামে গুলিবিদ্ধ একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা গেছেন। তবে তিনি বিএনপি কর্মী কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি ঢাকা পোস্ট।

পরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানান, অন্যায় ও পাশবিকভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানোর পাশাপাশি তাদের আটক করা হয়েছে। আজ ছয় শতাধিক নেতাকর্মী আটক হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই ব্যাগে করে বিস্ফোরক এনে রেখেছে। উল্টো এখন মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। কার্যালয় থেকে দলের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা সব ডকুমেন্ট নিয়ে গিয়েছে।  

রাতে নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ের সামনে এক ব্রিফিংয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, বিএনপির কার্যালয় থেকে নগদ ২ লাখ টাকা, ১৬০ বস্তা চাল, খিচুড়ি রান্নার উপকরণ এবং অবিস্ফোরিত ১৫টি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। সমাবেশ ১০ ডিসেম্বর, কিন্তু তিন-চার দিন আগেই অবস্থান নেওয়ার জন্য পৌনে দুই লাখ পানির বোতল, চালসহ রান্নার উপকরণ নিয়ে এসেছে বিএনপি।

এমএইচএন/এসকেডি