ছবি : সংগৃহীত

সত্তর বা নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে গ্রামে কেউ মারা গেলে মৃত বাড়িতে কিছু লোককে ভাড়া করে আনা হতো মৃত বাড়িতে এসে অত্যন্ত উচ্চস্বরে লাশের পাশে বসে কান্না করার জন্য। এদের বলা হয় রুদালি। এই রুদালিদের ভাড়া করার কারণ হচ্ছে এটি জানিয়ে দেওয়া যে, এই বাড়িতে কেউ মারা গেছেন এবং এটির জন্য তারা সবাই অসম্ভব রকমের ব্যথিত এবং একই সাথে একটি শোকাতুর পরিবেশ সৃষ্টি করাও ছিল উদ্দেশ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হিসেবে আন্তর্জাতিক যে লবিস্ট নিয়োগ করেছে এবং যেটি নিয়ে এখন দেশের রাজনীতি উত্তাল হয়ে রয়েছে এই পুরো ঘটনার সাথে আমি সেই রুদালি সংস্কৃতির বেশ মিল খুঁজে পাচ্ছি।

সারমর্ম একটিই, চিৎকার করে বিএনপি’র পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া যে, তারা ক্ষমতায় আসতে পারছে না এবং তাদের অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে লবিং করে বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলে সেটা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে আস্বাদন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর এই লবিং করার জন্য ভাড়া করা দল কিংবা বিভিন্ন উপদলকে সেই রুদালিদের সাথে তুলনা করা যায়।

লবিং সংস্কৃতি আমেরিকা-ইংল্যান্ডে একটি স্বীকৃত ব্যবসা এবং পুঁজিবাদী পশ্চিমারা এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ আয় করে থাকে। এই লবিং বাণিজ্য অন্য যে দেশে যাই-ই হোক না কেন, আমেরিকায় এটি অসম্ভব রকমের সুগঠিত এক ব্যবসা মাধ্যম এবং একই সাথে একটি চক্রের মতো।

লবিং বলতে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমরা বুঝে থাকি ‘একে ধরে-তাকে ধরে’ প্রভাব বিস্তার করে কাজ হাসিল করা। খাঁটি বাংলায় ‘তদবির’। অর্থাৎ যে কথাটি বা কাজটি আপনি বলতে বা করতে পারছেন না সেটি এমন কাউকে দিয়ে বলানো বা করানো যাতে যা বলতে বা করতে চাইছেন সেটি যেন একদিকে যথাস্থানে বলাও বা করানোও হয় অন্যদিকে এই বলার বা করার ফলে সেটির ফলাফল হিসেবে প্রতিপক্ষের জন্য একটা অস্বস্তির পরিবেশও তৈরি হয়।

এই লবিং সংস্কৃতি আমেরিকা-ইংল্যান্ডে একটি স্বীকৃত ব্যবসা এবং পুঁজিবাদী পশ্চিমারা এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ আয় করে থাকে। এই লবিং বাণিজ্য অন্য যে দেশে যাই-ই হোক না কেন, আমেরিকায় এটি অসম্ভব রকমের সুগঠিত এক ব্যবসা মাধ্যম এবং একই সাথে একটি চক্রের মতো।

আমেরিকায় যত লবিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে এরা মূলত সে দেশের কংগ্রেস সদস্য, সিনেট সদস্য থেকে শুরু করে হলিউড অভিনেতা-অভিনেত্রী, বড় বড় ব্যবসায়ী ইত্যাদি ব্যক্তিদের সাথে তাদের ক্লায়েন্টদের এক ধরনের সংযোগ করে দেয় কিংবা বিভিন্ন পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এইসব মাধ্যমেও ক্লায়েন্টের চাওয়া কিংবা আগ্রহের প্রকাশ ঘটায়। একই সাথে এইসব প্রফেশনাল লবিস্টরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের রাজনীতিতে বা পররাষ্ট্র বিষয়ক নানাবিধ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গতিপথও পরিবর্তন করে দেয়।

এই লবিং-এর পুরো ব্যাপারটা হতে পারে পজিটিভ আবার হতে পারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিএনপি যখনই এই লবিং সংস্কৃতিতে প্রবেশ করল তখন তাদের পুরো লক্ষ্যই ছিল শুরু থেকেই বাংলাদেশের বিদ্যমান সরকারকে নেতিবাচক রূপদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, পশ্চিমে যারাই লবিং পেশার সাথে যুক্ত তারা পরিষ্কারভাবে এটি প্রকাশ করেন এবং কার কার জন্য তারা কী কী বিষয়ে কাজ করছেন এটি প্রতিটি লবিং প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্য নথিপত্র দিয়ে সবাইকেই অন্তর্জালে জানিয়ে রাখে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ধরা যাক, একটি লবিং প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে ‘এক্স’। তাদের বিএনপির অনুরোধে বাংলাদেশের বিদ্যমান সরকারের বিরুদ্ধে বলার জন্য ভাড়া করল ‘ওয়াই’ নামের একজন ক্ষমতাশালী কংগ্রেস সদস্যকে।

এই কংগ্রেস সদস্যকে কিন্তু বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করা হয়েছে বিএনপির হয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বলার জন্য। এখন তিনি তাদের আইনসভা বলুন, নানাবিধ মিটিং বলুন, পার্লামেন্ট বলুন সবখানেই নির্ধারিত সময় ও প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সরকার নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করবেন যেটি অর্থ দেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পক্ষে যাবে।

এই কংগ্রেস সদস্যকে এসব বলার জন্য যে অর্থ দেওয়া হয়েছে এবং তিনি এই বিষয়ে বিক্রি হয়েছেন এই তথ্য কিন্তু যারা তার বক্তব্য শুনছেন তাদের একেবারেই অজানা নয়। পুরো বিষয়টাই সবার কাছে পরিষ্কার হলেও এইসব ব্যক্তিরা এতই প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ যে, তার সেই বক্তব্য কিংবা আবেদন ওই উত্থাপিত ফোরামে আলোচিত হয় এবং সেটির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মহল তৎপরও হয়ে ওঠে।

বিএনপির এই আন্তর্জাতিক তদবির বাণিজ্যের প্রসঙ্গ আজকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও এর শুরুটা হয়েছে ২০১২/২০১৩ সাল থেকেই। আমার হাতে প্রায় ৬ বছর আগের বিএনপির লবিং-এর যে নথিপত্র রয়েছে সেটিতে দেখা যাচ্ছে ‘একিন গাম্প (Akin Gump Strauss Hauer & Feld)’ নামের একটি আমেরিকান লবিং প্রতিষ্ঠানের সাথে বিএনপির চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারিতে।

লবিং-এর পুরো ব্যাপারটা হতে পারে পজিটিভ আবার হতে পারে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিএনপি যখনই এই লবিং সংস্কৃতিতে প্রবেশ করল তখন তাদের পুরো লক্ষ্যই ছিল শুরু থেকেই বাংলাদেশের বিদ্যমান সরকারকে নেতিবাচক রূপদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

টবি ক্যাডম্যান (Toby Cadman) নামের এক ব্রিটিশ আইনজীবী বিএনপির হয়ে বাংলাদেশে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, দেশের রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে মাসে ৪০ হাজার থেকে ১০০ হাজার ডলার অর্থ প্রদান করত একটি চুক্তি সম্পাদন করে। বলে রাখা ভালো যে, এই টবি ক্যাডম্যান জামায়াতে ইসলামীর হয়ে সারা পৃথিবীতেই লবিং করে বেড়িয়েছেন এবং জামায়াতের বিভিন্ন নেতাদের একাত্তরের নানাবিধ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার বিষয়ে নেতিবাচক সংবাদ ও তথ্য প্রচার করেছেন।

এই একিন গাম্প নামের লবিং প্রতিষ্ঠানের কাছে বিএনপির চাওয়া কী? এটা বলা বাহুল্য যে, সেই চাওয়া কোনোভাবেই বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশের বিদ্যমান সরকারের পক্ষে সুনাম বয়ে আনা এমন বিষয়ের চুক্তি নয়। বরং বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে অপমান করা আর বিরূপভাবে বিশ্ব দরবারে যাতে পরিচিতি পায় এটাই ছিল সেই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য।

এখানে দুটো তথ্য খুব প্রাসঙ্গিক। এক হচ্ছে, বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই লবিং-এর অংশ হিসেবে যা বলেছেন সেটি আর অন্যটি হচ্ছে, নিউ ইয়র্ক টাইমসে খালেদা জিয়া যে কলামটি লিখেছিলেন সেটির ভাষ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবের লিখিত চিঠি যেটি তিনি আমেরিকান নীতিনির্ধারক বরাবর পাঠিয়েছেন সেখানে স্পষ্ট দেখা যায় যে (১) তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে মার্কিন সাহায্য যাতে আর না আসে সে ব্যাপারে তিনি অনুরোধ করেছেন, (২) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছেন এবং (৩) বাংলাদেশ যাতে আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি খাতে জিএসপি সুবিধা না পায় সে বিষয়ে অনুরোধ করেছেন। 

একইভাবে খালেদা জিয়া ২০১৩ সালের জানুয়ারির ৩০ তারিখে লিখিত ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় ‘ZIA: The thankless role in saving democracy in Bangladesh’ শীর্ষক একটি কলাম লেখেন এবং সেখানে পরিষ্কারভাবে তিনি পশ্চিমাদের আহ্বান করেন যে, বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় যাওয়া ভ্রমণকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়াসহ অনেক বিষয়। একইভাবে তিনি বাংলাদেশে তৎকালীন চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হতে থাকা অভিযুক্তদের বিচারের তীব্র সমালোচনাও করেন। 

সেই আর্টিকেলেই লেখা রয়েছে, ‘The Western powers should consider targeted travel and other sanctions against those in the regime ... They should say and do these things publicly... This is how the United States can ensure that its mission to democratize the world continues.’
বলে রাখা ভালো যে, বেগম খালেদা জিয়ার এই কলামটিও তাদের লবিং-এর একটি অংশ হিসেবে এই আউটলেটে প্রকাশিত হয়েছে বলেই ধারণা করা যায়।

বিএনপির এই আন্তর্জাতিক তদবির বাণিজ্যের প্রসঙ্গ আজকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও এর শুরুটা হয়েছে ২০১২/২০১৩ সাল থেকেই।

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই দেশ নিয়ে তিনি যখন এমন ভাষায় এমন কদাকার আহ্বান জানান এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন একটি অবয়ব দাঁড় করান তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায় যে, বিএনপির প্রতিটি কর্মকাণ্ডই কি রাষ্ট্রবিরোধী? রাষ্ট্রদ্রোহী? এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন সু-স্পষ্টভাবে বিএনপির কর্মকাণ্ডকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দিকেই নির্দেশ করে। বাংলাদেশের পেনাল কোডের ১২৪(ক) ধারায় পরিষ্কারভাবে বলা রয়েছে যে— 
‘Whoever by words, either spoken or written or by signs or by visible representation or otherwise, brings or attempts to bring into hatred or contempt or excites or attempts to excite disaffection towards, the Government established by law shall be punished...’
ভাষা অত্যন্ত পরিষ্কার। যে ব্যক্তি উচ্চারিত বা লিখিত শব্দের মাধ্যমে কিংবা কোনো প্রতীকের মাধ্যমে সরকারের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষের উদ্ভব করেন কিংবা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন বা বৈরিতা সৃষ্টি করেন তিনি এই আইনের আওতায় পড়ে যাবেন। এই বিষয়ে ১৯ ঢাকা ল' রিপোর্টস (ডি. এল. আর.)-এ রাষ্ট্র বনাম সর্দার আতাউল্লাহ খান মামলায় আদালত তার রায়ে বলেছেন, বক্তব্য সত্য কি মিথ্যা সেটির থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রদত্ত বক্তব্য কি আসলে সরকারের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ কিংবা বৈরিতা সৃষ্টি করছে কি না। তবে ৩৫ ডি. এল. আর.-এ মজিবর রহমান বনাম রাষ্ট্র মামলায় অবশ্য এটিও বলা রয়েছে যে, এই রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়ে প্রমাণ-সাক্ষী সবকিছুই রাষ্ট্রকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে হবে।

এ পর্যন্ত লবিং কেন্দ্রিক তথ্য-প্রমাণ ও নথিপত্র দেখে এটি নিরূপণ করতে মোটেও কষ্ট হয় না যে, আপাত দৃষ্টিতে বিএনপির কর্তাব্যক্তিরা লবিং করার নামে মিথ্যাচার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে ক্ষতি সাধন করেছেন এবং যে ঘৃণা বিদ্বেষ ও বৈরিতার এক পরিবেশ তৈরি করেছেন তাতে করে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধেই মূলত অভিযুক্ত।

কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এসব অমার্জনীয় অপরাধের বিচারের গুরুদায়িত্ব শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কেননা আইন অনুযায়ী একক ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত এই ধরনের মামলা দায়ের করতে পারেন না এবং একই সাথে আদালতও রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া অভিযোগ আমলেও নিতে পারেন না। 

ফলে দেখার বিষয় হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নেয়। অপরাধীকে তার অপরাধের জন্য যদি শুরুতেই বিচারের মুখোমুখি না করা যায় তবে সে অপরাধী ভবিষ্যতের জন্য হয়ে ওঠে ভয়াবহ আর এই বিষয়টি রাষ্ট্র যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে, ততই মঙ্গল।

নিঝুম মজুমদার ।। ব্যারিস্টার এবং সলিসিটর