>> ২২ অথবা ৩০ ডিসেম্বর হতে পারে গণমিছিল

>> বিএনপির শরিকরা ত্রি-ধারায় বিভক্ত, সন্দেহের তীর জামায়াতের দিকে

>> ঢাকা বাদে সারাদেশে গণমিছিল হবে ২৪ ডিসেম্বর

সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে ১০ দফার ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো যুগপৎ আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে আগামী ২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে গণমিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দেয় দলটি। কিন্তু একই দিন রাজধানীতে আওয়ামী লীগের সম্মেলন থাকায় সম্ভাব্য ‘সংঘাত’ এড়াতে এবং শরিকদের আপত্তির কারণে যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, বিএনপি কোনো সংঘাতে যেতে চায় না। শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পরাজিত করাই তাদের লক্ষ্য। সেজন্য পূর্বঘোষিত ২৪ ডিসেম্বরের গণমিছিল কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। তবে ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ২৪ ডিসেম্বরই গণমিছিল কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তারা।

গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এই ১০ দফার ভিত্তিতে আগামীতে যুগপৎ আন্দোলন করবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। ওই দিন ২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারাদেশে গণমিছিল কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হয়।

কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার রাতে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছেন। আমি বিষয়টি বিবেচনায় নেব। এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সব বিভাগীয় সমাবেশ শনিবারই করেছি। সর্বশেষ ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশও শনিবার করেছি। সেই অনুযায়ী আগামী ২৪ ডিসেম্বর শনিবার গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। আমরা যখন কর্মসূচি ঘোষণা করি তখন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহ্বান জানিয়েছেন, আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নেব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, আমরা অপ্রয়োজনে কোনো সংঘাতে যেতে চাই না। ঢাকায় গণমিছিলের তারিখ পরিবর্তন করা হবে। সে বিষয়ে অন্যান্য শরিকদের পক্ষ থেকে কী প্রস্তাব আসে সেটার ওপর ভিত্তি করে স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ২৪ ডিসেম্বর কর্মসূচি ঘোষণা করে। এটা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল মঞ্চের মধ্যে। তাছাড়া ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলন। ফলে শুরুতেই সংঘাতে যাওয়া ঠিক হবে না। যদিও বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা আওয়ামী লীগের ২৪ ডিসেম্বর সম্মেলনের বিষয়টি জানতেন না। তারা পূর্বের সমাবেশের ন্যায় শনিবারের দিন গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে আলোচনার পর তারা বিষয়টি জানতে পেরেছেন।

এখন তারা গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের বলেছেন, গণমিছিল ঢাকায় কবে করলে ভালো হবে সে রকম একটি তারিখ ঠিক করে বিএনপিকে যেন জানাই। যদিও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের মধ্যে আলোচনা হয়নি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘দিনের ভোট রাতেই ডাকাতি হয়েছে’। তাই আমাদের চিন্তা-ভাবনা আগামী ৩০ ডিসেম্বর ‘ভোট ডাকাতির বর্ষপূর্তি’র দিন এ গণমিছিল করার।

অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের আরেক শরিক ২০ দলীয় জোটের একটি দলের শীর্ষ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা আমাদের জানিয়েছেন, ঢাকায় ২২ ডিসেম্বর গণমিছিল হবে। সেই অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।

এদিকে জোট শরিকদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। আর সেটি স্পষ্ট হয় জোট শরিকদের নেতারা সোমবার যখন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিদর্শনে যান তখন। ওই দিন অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির নেতাকর্মীরা এককভাবে বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত কার্যালয় পরিদর্শন করেন। এরপর জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ আরও ৯টি দলের যৌথ নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শনে যায়। তাদের পরে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহান, জাগপার চেয়ারম্যান খন্দকার লৎফুর রহমানসহ ৫ জনের একটি টিম বিএনপি কার্যালয় পরিদর্শন করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জোট শরিকদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকত তাহলে ওই দিন তারা আলাদাভাবে নয় বরং এক সঙ্গে বিএনপির ক্ষতিগ্রস্ত কার্যালয় পরিদর্শন করতেন।

এ বিভক্তির পেছনে জামায়াতকে দায়ী করছেন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে ত্রি-ধারার বিভক্তির পেছনে হাত রয়েছে জামায়াতের। তারা আমাদের সঙ্গেও যুগপৎ আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের ত্রি-ধারায় বিভক্ত করে রেখেছে। ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দলে এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সব জায়গায় জামায়াতের লোক। জামায়াতের এ অবস্থান অনেকটা এ রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ‘সতীনের ছেলেকে আদর-যত্ন করে কোলে রেখে অকর্মা বানিয়ে দেওয়ার মতো।’ অর্থাৎ ২০ দলীয় জোটের নেতারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের থাকবে কিন্তু তারা চলবে জামায়াতের ইশারায়। তারাই বিভিন্ন সময় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে চান না তারা।

এ বিষয়ে জাগপার একাংশের চেয়ারম্যান খন্দকার লৎফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া পর ২০ দলীয় জোটে বিভক্তি শুরু। সবাই নিজে কীভাবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হবে, সেটাই নিয়ে ভাবছে। এ কারণে জোটের শরিকরা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আলাদা-আলাদাভাবে বিএনপি কার্যালয় পরিদর্শনে যান। এখানে জামায়াতের কোনো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২০ দলীয় জোটের একটি দলের শীর্ষ নেতা বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে যেসব দল আর্থিকভাবে দুর্বল, তাদের বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছে জামায়াত। সেখানে লেবারপার্টি, এলডিপি, কল্যাণ পার্টির, জাগপার নাম আসে আগে। এর বাইরে বিভিন্ন দলের চেয়ারম্যান বা মহাসচিব ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বিভিন্ন সময়। ফলে জামায়াতের একটা প্রভাব তো ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দলের মধ্যে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে সব দলে জামায়াতের প্রভাব আছে, এটা ঠিক নয়। আর জামায়াতের আর্থিক সুবিধা বিএনপির কিছু নেতাও গ্রহণ করেছেন, এখনও হয়ত করেন।

তিনি আরও বলেন, ২০ দলীয় জোটে এ বিভক্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ অলি আহমদ সব কিছু নিজেই নিয়ন্ত্রণ করেন। তার সঙ্গে কিছুদিন সৈয়দ ইব্রাহিমের দল ছিল, তিনিও এখন সেখানে থেকে সরে এসেছেন। অন্যদিকে এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহান বিএনপির মহাসচিবের কাছের লোক। তিনি ২০ দলের অনেক নেতাকে বিভিন্ন আশা দেখিয়ে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করেন।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, জামায়াত বিএনপির সঙ্গে এখন এমন আচরণ করছে, সেটা সতীনের ছেলেকে কোলে রাখার গল্পের মতো। তারা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনও করতে চায়, আবার বিএনপির অন্য জোটসঙ্গীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে বিভক্ত করে রেখেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সঙ্গে জামায়াত নেই এবং এই বিভক্তির পেছনে জামায়াত দায়ী বলেও আমরা মনে করি না। আমাদের যৌথ নেতৃত্বে এটি চলছে।

এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এএইচআর/এসকেডি