আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুগপৎ আন্দোলন করছে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলো। চলমান এই আন্দোলনকে সফল করে তুলতে এবং যুগপতের বাইরে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে কাছে টানতে যৌথ ইশতেহার দেবে একত্রিত হওয়া দলগুলো।

বিএনপির ঘোষিত ১০ দফা এবং গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফাকে সমন্বয় করে এই ইশতেহার তৈরির কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। যা চলতি মাসের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘সরকার ও শাসনব্যবস্থা’ বদলের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ৭ দফা শীর্ষক খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের ৪ সদস্যের একটি দল। কিছু সংযোজন-বিয়োজন হয়ে এই খসড়া চূড়ান্ত হবে। কারণ খসড়া রূপরেখার কিছু শব্দ নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে আপত্তি উঠেছে। এটা ঠিক হওয়ার পর আগামী ২-১ দিনের মধ্যে খসড়া রূপরেখা নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ও গণফোরাম-পিপলস পার্টি এবং এলডিপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে বিএনপি। তাদের কোনো মতামত থাকলে এবং সেটির গ্রহণযোগ্যতা যুক্ত করে চূড়ান্ত রূপরেখা করা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই এই রূপরেখা দেওয়া হবে। আমরা ১০ দফা দিয়েছি, গণতন্ত্র মঞ্চ ১৪ দফা দিয়েছে, আর গণফোরাম ৮ দফা দিয়েছে। এই সবগুলো মিলিয়ে আন্দোলনের রূপরেখা দেওয়া হবে।

কবে এই রূপরেখা ঘোষণা করা হবে তার দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলেও জানান বিএনপির এ নেতা। আর সেই অনুষ্ঠানে কারা-কারা থাকবে তাও ঠিক হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দলীয় জোটের নেতা বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্দোলনের ইশতেহার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনও আলোচনা হয়নি। তবে, খুবই শিগগিরই আলোচনা হবে। আগামী ২-১ দিনের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে আমাদের বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএনপি-গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিরোধী আন্দোলনের যৌথ খসড়া রূপরেখায়- সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নিরপেক্ষ সরকারের দাবির পাশাপাশি ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাষ্ট্র কাঠামোর কি ধরণের পরিবর্তন আনা হবে তা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রের উৎস প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতা ব্যবস্থার পরিবর্তন, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এখানে কিছু শব্দ নিয়ে বিএনপির মধ্যে আপত্তি উঠেছে।

‘সরকার ও শাসনব্যবস্থা’ বদলের লক্ষ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ৭ দফা শীর্ষক খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের ৪ সদস্যের একটি দল। কিছু সংযোজন-বিয়োজন হয়ে এই খসড়া চূড়ান্ত হবে। কারণ খসড়া রূপরেখার কিছু শব্দ নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে আপত্তি উঠেছে।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক নীতিমালা প্রণয়নের কথাও খসড়া রূপরেখায় উল্লেখ করা হয় ।

যুগপৎ আন্দোলনের খসড়া রূপরেখার তৃতীয় দফায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সহ নিবর্তনমূলক আইন বাতিল, রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না- এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

আর চতুর্থ দফায়- বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, শেয়ার মার্কেট, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা ও নগদ অর্থ সহায়তা চালু, বিদ্যুৎ খাতের রেন্টাল-কুইক রেন্টালের দায়মুক্তি আইন বাতিলের বিষয়গুলো আনা হয়েছে।

পঞ্চম দফায়- বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

আর ষষ্ঠ দফায়- ঘরেবাইরে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করা, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে হামলা-লুটপাটের বিচার করা। সর্বশেষ সপ্তম দফায়- জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সমাধানের বিষয়টি উঠে এসেছে।

ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠকে যৌথ আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখন বিএনপি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করবে। আশা করছি- এই মাসের শেষের দিকে যৌথ আন্দোলনের রূপরেখা সংবাদ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।

নাম না প্রকাশের শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, খসড়া রূপরেখায় বেশকিছু শব্দচয়ন নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে আপত্তি উঠেছে। এর মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার যে বিষয়টি বলা হয়েছে, এখানে শব্দ ও ভাষাগত কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এর বাইরে বিএনপির ১০ দফায় (১৯৯৬ সালের সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে) একটি দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা বলেছিলো। কিন্তু যৌথ আন্দোলনের খসড়া রূপরেখায় বিষয়টি উঠে আসেনি। ফলে, চূড়ান্ত রূপরেখায় এই বিষয়টি যুক্ত করা হবে। এছাড়া এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা সবচেয়ে বেশি ভারতের। তবে, এই বিষয়ে এমন কোনও শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করা হবে না, যাতে ভারত বিএনপির ওপর চটে যায়।

খসড়া রূপরেখা তৈরিতে যুক্ত ছিলেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, খুব শিগগিরই এটি আমরা প্রকাশ করবো। আসলে প্রত্যেক সপ্তাহে আমাদের কর্মসূচি চলছে, আবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। এখন তিনি দেশে এসেছেন। ফলে, সব পক্ষের মতামত নিয়ে রূপরেখা চূড়ান্তের পর অনুষ্ঠান করে এটি প্রকাশ করা হবে। 

বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, এখনও যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা দলগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। ইতোমধ্যে অনেকে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করতে আগ্রহী হয়েছে। তবে, তারা আরও কিছুদিন সময় নিতে চায়। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গেও বিএনপির অনেকের ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা চলছে।

এএইচআর/এমজে