শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২ আসন। ৬২ আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। যাদের অধিকাংশ স্থানীয় আওয়মী লীগের নেতা। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। দলটির দুর্গ বলে পরিচিতি রংপুরে তারা জিতেছে মাত্র তিন আসনে। তাও সেসব আসনে নৌকা প্রার্থীরা ভোট করেননি।

কেন জাতীয় পার্টির মতো দলের এমন ভরাডুবি? দলটি কি আসলেই দিশা হারিয়েছে? তারা কি বাংলাদেশের জনগণের কাছে এখন এতটাই অপাঙক্তেয়? এসব বিষয়ে এবং সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থানসহ নানা প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্ট কথা বলেছে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং ঢাকা-৭ আসনে পরাজিত প্রার্থী হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলনের সঙ্গে।

একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি উন্মোচন করেছেন দলটির অভ্যন্তরীণ নানা অনিয়ম, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে দলকে ব্যবহার, কিছু নেতাকর্মীর দুর্নীতিসহ অনেক বিষয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।

ঢাকা পোস্ট : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। এ নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন : নির্বাচন আসলে কতটা ফেয়ার হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বলা যায় না। এমনিতে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু গোপনে সিল মারা হয়েছে কি না সেটা ক্লিয়ার না। আমার এলাকায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টা পর পোলিং এজেন্ট বসতে দিয়েছে। এই দুই ঘণ্টায় কী করা হয়েছে সেটা তো জানি না। তবে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে কোনো অনিয়ম চোখে পড়েনি। ভোটার সংখ্যা ছিল না বললেই চলে। সকাল ও বিকেলে বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে আমি যে ভোটার উপস্থিতি দেখেছি তাতে মনে হয়েছে ৮ থেকে ১২ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা নয়। তবে ভোটের রেজাল্ট হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক মনে না করলে আপনার আসনে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানাবেন কি না?

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন : না। এ দাবি তো আমি করতে পারব না। তা ছাড়া, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক যারা এসেছেন তারা সবাই দেখেছেন। তুরস্কসহ বিশ্বের কিছু কিছু দেশে নির্বাচনের একটি নিয়ম হলো নির্বাচন বৈধ হতে নির্ধারিত সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি থাকা লাগবে। কিন্তু বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কত শতাংশ ভোট পেতে হবে এমন কোনো ক্রাইটেরিয়া নেই। এ কারণে দুই থেকে তিন শতাংশ ভোট পেলেও নির্বাচন বৈধ হয়ে যাবে।

ঢাকা পোস্ট : ২৬ আসনে সমঝোতা থাকলেও জাপা আসন পেয়েছে মাত্র ১১টি। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন : আসন সমঝোতায় আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সাথে বেঈমানি করেনি। কিন্তু জাতীয় পার্টি জাতির সাথে বেঈমানি করেছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও জাতির সাথে বেঈমানি করেছে। কারণ, পাঁচ বছর আগে নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও তিনি দেশ ও জাতিকে বলে আসছিলেন— এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কিন্তু তিনি নিজেই নিজের কথা রাখেননি। জিএম কাদের নিজের এবং পরিবারের স্বার্থে দলকে বিসর্জন দিয়েছেন। দেশের মানুষের কথা না ভেবে নিজের লাভ দেখে নির্বাচনে গেছেন। এতে তার নিজের এবং দলের ইমেজ নষ্ট হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ২৬ আসন ছাড় দিলেও কখনো এ কথা বলেনি— স্বতন্ত্র প্রার্থী উঠিয়ে নেব বা ভোটে পাস করিয়ে দেব। বরাবর শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদের বলে আসছেন— তোমাদের পাস করে আসতে হবে। তারা বলেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। কিন্তু জাতীয় পার্টি তো নৌকার সাথে হারেনি। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাথে হেরেছে। কোনো কোনো জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সাথে লড়তে গিয়ে চার থেকে পাঁচ নম্বর হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানেও থাকতে পারেনি। আবার কোনো জায়গার দ্বিতীয় হয়েছে কিন্তু ভোটের ব্যবধান ৮০ হাজার। যেমন ঢাকা-১৮ তে আমাদের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জি এম কাদেরের স্ত্রী পাঁচ হাজারের মতো ভোট পেয়েছেন। এটাও তো সমঝোতার সিট। আওয়ামী লীগ তো বলে নাই তোমাদের পাস করিয়ে দেব। তারা নৌকার প্রার্থী সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মাঠে বাকিদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে হবে তো। এখানে আওয়ামী লীগের কোনো দোষ নেই।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে দেউলিয়া হয়ে গেছে বলে মনে করেন অনেকে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন : অনেকে মনে করার কিছু নেই। দেশের শতভাগ মানুষ এখন মনে করে জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক দল হিসেবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। দলের অনেক নেতারাও তাই মনে করেন।পার্টির মহাসচিব এবং হাতেগোনা কয়েকজন নেতা মিলে তাদের নিজেদের স্বার্থে এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ দল আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। জাতীয় পার্টির অফিসিয়াল পেজ ঘুরে যদি কমেন্টগুলো পড়েন দেখবেন মানুষ জাতীয় পার্টিকে মীরজাফর বলে চেনে। এটা শুধু আপনার আমার কথা নয়, পুরো জাতির কথা। এ কারণেই আমরা বিব্রত।

সবাই তো আর রাজনীতি করে সংসার চালায় না। আমি নিজের পকেটের অর্থ দিয়ে রাজনীতি করি। মানবসেবা করি। জি এম কাদের তার নিজের এবং পরিবারের স্বার্থে এ দলটিকে ধ্বংস করেছে। তার স্ত্রীকে ঢাকা-১৮ আসনে সমঝোতার তালিকায় না নিলে আমাদের কাজী ফিরোজ রশিদ ও আবু হোসেন বাবলা সংসদ সদস্য হতে পারতেন। অপরদিকে আমার ঢাকা-৭ আসনটি সমঝোতায় নিলে আমিও সহজে বিজয়ী হতাম। নৌকা ছাড়া আমার আসনে কোনো শক্তিশালী প্রার্থী ছিল না। এখানে একটা সুযোগ ছিল।

ঢাকা পোস্ট : আপনি বললেন— জিএম কাদেরসহ কয়েকজন নেতা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এ তালিকায় আর কে কে আছে? 

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন : এক পরিবার থেকেই জি এম কাদের নিজে, তার স্ত্রী-ভাগ্নেসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন এবং কিছু চামচা এই সমঝোতার তালিকায় ছিলেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীসহ অনেকের বিষয় তো আপনারা জানেন। এরা মিলেই তো দলকে শেষ করে দিয়েছে। এরা তো পার্টির চাঁদার টাকাও মেরে খায়। এ নির্বাচনে পার্টির নমিনেশন বিক্রি হয়েছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী পার্টিতে টাকা দেয় সেই সব টাকাও তারা মেরে খায়। এরা তো জাতির সাথেই বেঈমানি করেছে।

ঢাকা পোস্ট : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন : আপনাকে এবং ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।

এমএম/এমজে