জুলাই সনদ : গণভোটে ঐকমত্য, সময় নিয়ে মতানৈক্য
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের মতামত নিতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য এসেছে। বিষয়টিকে সাফল্য হিসেবে দেখছে ঐকমত্য কমিশন। তবে গণভোট কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি বলছে, সাধারণ নির্বাচনের দিনই গণভোট করা হোক। জামায়াতে ইসলামী বলছে— জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে হোক। অন্যান্য দলগুলোও মিশ্র অবস্থান জানিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
রোববার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চতুর্থ দিনের মতো আলোচনায় বসেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৈঠকের বিরতিতে ও শেষে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের মত ও আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানায় রাজনৈতিক দলগুলো।
বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
বৈঠক শেষে কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার জন্য আমরা এটিকে প্রথম বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি।
কী বলছে বিএনপি
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের রায় নেওয়ার জন্য সংসদ নির্বাচনের দিন আলাদা ব্যালট রাখার কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, আজকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় একটা ফাইনাল স্টেজে আমরা আছি। সর্বশেষ যে রিকমেন্ডেশন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রেরণ করা হবে, সেই বিষয়ে আমরা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এ বিষয়ে আজকের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে মোটামুটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে মনে হয় আমরা এগোতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, রেফারেন্ডামের যে প্রশ্নটা এসেছে, এটা মূলত আমাদের বিগত সভার প্রস্তাবের মধ্যে আমি একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। জুলাই জাতীয় সনদ গ্রহণ করার বিষয়ে এবং বাস্তবায়নের বিষয়ে জনগণের সম্মতি আছে কি না, সেজন্য জনগণের কাছে আমরা যাই। আমরা এটা একটা রাজনৈতিক সভা, এখানে আমরা সব ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গঠিত সব রাজনৈতিক দল আলোচনা করেছি। কিন্তু তারপরও আমরা সব দল মিলে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে রিপ্রেজেন্ট করি কি না, এটা একটা প্রশ্ন।
‘সমগ্র জনগণের কাছে আমরা যদি এই সম্মতিটা নিই যে, আমরা রাজনৈতিক দলগুলো এভাবে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি; জনগণ তার পক্ষে আছে কি না। তখনই হবে জনগণের পক্ষ থেকে এই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি চূড়ান্ত অভিমত, যা সার্বভৌম ক্ষমতার একটি রায়।’
বিএনপির সিনিয়র এ নেতা আরও বলেন, জাতীয় সনদের যে অংশগুলোতে আমরা পুরোপুরিভাবে ঐকমত্য হয়েছি (কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভিন্নতা বা নোট অব ডিসেন্ট আছে); জনগণ যদি তার পক্ষে রায় দেয়, তবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পরবর্তী সংসদের সমস্ত সংসদ সদস্য বাধ্য থাকবেন। সেজন্য আমরা সংসদ নির্বাচনের দিন আলাদা একটি ব্যালটে জুলাই জাতীয় সনদের পক্ষে জনরায় নেওয়ার জন্য বলেছি। এই গণভোট (রেফারেন্ডাম) অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের সংবিধানে কোনো সংশোধনী আগে আনতে হবে না।
যা বলেছে জামায়াতে ইসলামী
বৈঠকের বিরতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই গণভোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
গণভোট কবে হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনগণ গণভোটে অভ্যস্ত নয়। আমরা মনে করি, এটি যাতে জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের সমস্যায় না ফেলে, নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরেই এটা করা যায়। নির্বাচনের তফসিলের আগেও করতে পারেন। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই। জনগণকে একটা জটিল অবস্থায় না ফেলে বা মহাপরীক্ষায় না ফেলে সহজভাবে এগিয়ে গেলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।
তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি রচনার জন্য যদি গণভোটে যায়, তাহলে এটা হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্টও এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কোনো দূরত্ব নেই জানিয়ে এ জামায়াত নেতা বলেন, গণভোটের রেজাল্ট যদি আমাদের বিপক্ষেও যায়, আমরা এখানে ছাড় দেব।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমরা সবসময় সোচ্চার ছিলাম। সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের পক্ষে সবাই মত দিয়েছেন।
তিনি বলেন, গণভোট আগে না পরে— এটা আলোচনার সুযোগ আছে। তবে, সবাই গণভোটের পক্ষে একমত হয়েছে। গণভোট আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। তার জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে একটা নিদের্শনা দিতে পারে। এরপর কমিশন গণভোটের আয়োজন করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায় এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, এ সরকারের সময়েই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। কারণ পরবর্তী সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা বাদ দিয়ে দিতে পারে। তাই জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকারকেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। যেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। এ বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে।
তুষার আরও বলেন, ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত। যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দেবে। নোট অব ডিসেন্টে যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলোকেও 'একমত' বলে ধরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা মনে করি সব রাজনৈতিক দল একমত হলে জনগণ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে।
৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে : রাশেদ খান
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, সরকার তিনটি দলকে গুরুত্ব দেয়। সেই তিন দলকে এক জায়গায় আনা যাচ্ছে না। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং সনদের পক্ষে ভোটগ্রহণ নিয়ে সবাই একমত। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের অনুমোদন দিতে হবে।
যা বলল এবি পার্টি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু বলেছেন, আলোচনায় একটাই বিতর্ক, তা হলো জুলাই সনদ। জুলাই সনদে আমরা একমত। একটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দুটো ক্ষমতা পেয়েছি– একটি সংশোধন অন্যটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা। ক্ষমতা দিয়েছে গণঅভ্যুত্থান। সরকার পালিয়ে গেছে, তাই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবে সরকার বদল হয়নি। এবি পার্টির পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা আদেশ আকারে জারি করতে পারেন। এজন্য একটা গণভোট হতে পারে। গণভোটের মাধ্যমে মতামত নেব। সাংবিধানিক বিতর্ক তোলা হচ্ছে... এই সংকট সাংবিধানিক না। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন সংকট হলে আরও একটা গণঅভ্যুত্থান হবে। তখন পালাতে ৬ থেকে ৭টি হেলিকপ্টার লাগলে, কেউ পালানোর পথ পাব না।
এমজে