বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও এখনকার মতো একই রকমভাবে সমালোচনা গ্রহণ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিরা। তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর তারেক রহমান প্রথম নিজেকে নিয়ে আঁকা কার্টুন শেয়ার করেছেন। আশা করব, আগামীতেও কার্টুন আঁকা কিংবা রাজনীতিবিদদের নিয়ে কৌতুক করার সুযোগ থাকবে। না হলে আবারও বিএনপির সমালোচনা করতে হবে।

রোববার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে জাতীয় দৈনিক, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক ও প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় করে বিএনপি। রেডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেনে বিএনপির উদ্যোগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে এ সভা হয়।

যায়যায়দিনের সম্পাদক শফিক রেহমান বলেন, ‘সাংবাদিকদের দায়িত্ব সমালোচনা করা... ঠিক আছে কিন্তু প্রশংসা করাও তাদের দায়িত্ব– এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমি যখন আবার ফিরে পেলাম যায়যায়দিন, আমি সম্পাদকীয় বিভাগকে বলেছি, তোমরা খেয়াল রাখবে একটা ছোটোখাটো প্রশংসার কাজও যদি হয় ব্যক্তিগতভাবে বা সরকারিভাবে, ওই কথাটা সম্পাদকীয়তে লিখবে। খালি সমালোচনা করো না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকদের দায়িত্ব প্রশংসা এবং সমালোচনা দুটো করাই। আপনাদের অনুরোধ করছি, সাংবাদিক হয়ে যাওয়া মানে ফ্রি লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া, সরকারের সমালোচনা করা, ইউনূস সাহেবের সমালোচনা– এটা কিন্তু নয়। আমি কিন্তু সরকারকে টেনেই বলছি।’

শফিক রেহমান বলেন, ‘এখানে আমি মাহফুজ (মাহফুজ আনাম) এর একটা কথা বলতে চাই... উনি চলে গেছেন। আশা করি তার সহযোগী মতিউর রহমান আমার কথাটা তার কাছে পৌঁছে দেবেন। তিনি বলেছেন যে, সাংবাদিক ভুল করতে পারে। ধন্যবাদ এই কথাটা বলার জন্য।’

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি দেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা রয়েছে, চলছে... এটা একটা বিপজ্জনক এবং সেটা বিএনপির জন্যও কিছুটা কঠিন অবস্থা। আমি সবসময় ভাবতাম বা এখনো মনে করি যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বেশ একটু আগে যদি আসতে পারতেন তাহলে এক্ষেত্রে হয়ত বিএনপি এবং দেশের মধ্যে একটা ভালো সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হতে পারত। ওনার অনুপস্থিতিটা কিছুটা আপনাদের জন্য প্রশ্ন তৈরি করেছে, নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেটা আপনাদের জন্য নেতিবাচক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। একইসঙ্গে যদি বলি এই একটা বছর বা ১৫ মাস ধরেও বিএনপির সকল কর্মকাণ্ড নানা স্তরে নানাভাবে নানা ক্ষেত্রে যেভাবে হয়েছে, যতটুকু জানি বা যতটুকু জানি না– সেটুকু কিন্তু বিএনপির জন্য খুব ভালো হয়নি। সেগুলো এখনো সংশোধন করার বা ভালো করার সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।’

তিনি বলেন, ‘আপনাদের দলটা অনেক বৃহৎ এবং আমি মনে করি এখন পর্যন্ত বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল... এটা স্বীকৃত। আর আমাদের জরিপ যেটা আমরা করেছি– আমরা এটা বিশ্বাস করি যে জরিপ মোটামুটি সত্যের কাছাকাছি বা মানুষের চিন্তা জগতের কাছাকাছি। সেখানে বিএনপি কিন্তু বৃহত্তম দল হিসেবে এসেছে এবং নির্বাচনে অনেক বেশি ভোট পেয়ে তারা বিজয়ী হবেন।’

প্রথম আলোর সম্পাদক আরও বলেন, ‘আমরা এটা বিশ্বাস করতে চাই বা এটা হয়ত আমরা ভাবতে পারি যে, আপনারা ক্ষমতায় আসছেন। ক্ষমতায় আসছে যে দল, সে দলের নেতৃত্ব, সে দলের সকল পর্যায়ের নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনীর সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যে সেই আচরণে বিনয়, সৌজন্য ও ভদ্রতা অনেক বেশি করে প্রতিফলিত হওয়া দরকার।’

প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার মানুষ পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন মতিউর রহমান।

ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘মনে রাখবেন যে বাংলাদেশের ৫৩ বছর বয়সে কোনো মিডিয়ার অফিস আগুন দিয়ে জ্বালানো হয়নি। প্রথমবারের মতো প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অফিসে আগুন জ্বালানো হয়েছে। কেন? আমরা কি অপরাধ করলাম? আমি এটা অনুরোধ করব সমস্ত মিডিয়াকে যে সত্যিকার অর্থে আপনারা এটা প্রশ্ন করবেন। তবে ভবিষ্যতের দিকে আমি তাকাতে চাই। আমি সুন্দর একটি সম্পর্ক তুলতে চাই। সেখানে আমার অনুরোধ থাকবে– প্রথমত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে স্টেপ ওয়ান। এটা রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হবে। ক্রিটিক্যাল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; আপনার সমালোচনা করব, সেই স্বাধীনতা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন সালাউদ্দিন ইউ আর ভেরি ফ্রেন্ডলি টু মিডিয়া বিকজ ইউ আর আউট অব পাওয়ার। আপনি ক্ষমতায় গেলে কেমন হবেন? সেটা আমরা যখন দেখব যে একই রকম উদার, একই রকমভাবে আপনি গ্রহণ করছেন সমালোচনা। আমাদের এই ৫৩ বছরের রাজনীতিতে বড় অভিজ্ঞতা হলো যে, কোনো সরকার কোনোদিন তারা ক্রিটিক্যাল জার্নালিজম একসেপ্ট করে নাই।’

মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘একটা অস্থির সময়, কঠিন সময়। দেশটা দুভাগে বিভক্ত। বিভাজনের মধ্যে কথা বলাও খুব ডিফিকাল্ট। তবে আজকের এই অনুষ্ঠানে এসে আমার খুবই ভালো লেগেছে।’

তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মিডিয়া পলিসি কি হবে– সালাউদ্দিন আহমেদ ও রিজভী আহমেদ দুইজনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। আমি খুবই আশাবাদী হতে চাই যে, আগামী দিনে যদি তার সিকিভাগ বাস্তবায়িত হয়, মিডিয়া পলিসি যেটা বলা হয়েছে তারা যদি সেটা বাস্তবায়ন করেন, তাহলে বোধ হয় বাংলাদেশের মিডিয়া সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।’

মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে। তারেক রহমান এমন এক সময় আসছেন যখন বাংলাদেশে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপত্তা। মানুষ নিজেকে নিরাপদ ভাবতে চায়। কিন্তু মানুষ কিন্তু এখন নিরাপদ ভাবতে পারছে না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই নিরাপদ থাকতে চাই, লিখতে চাই, কথা বলতে দিন। আপনারা যদি এটা নিশ্চিত করেন সাধুবাদ জানাব। আর না হলে আবারো হয়তবা আমরা আপনাদের সমালোচনা করব, কিন্তু এই সমালোচনা যেন হঠকারিতায় পরিণত না হয় সেই দিকটাও আমাদের দেখতে হবে।’

গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব কামাল আহমেদ বলেন, ‘কৌতুক করার অধিকার মানুষকে দিতে হবে। তারেক রহমানের আমি প্রশংসা করি এই কারণে যে, তিনি একটি দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন... যে প্রথমে একটি কার্টুন শেয়ার করেছিলেন নিজের ছবি নিয়ে। ভবিষ্যতে যাতে আরও কার্টুন হয় এবং সেই কৌতুক করার সুযোগটা যাতে থাকে... আপনাদের মাঠ পর্যায়ের সমর্থকরা কিংবা মধ্যম সারি ও নিম্ন সারির নেতারা যেন তেড়ে না আসেন, তা আপনাদের তাদেরকে শেখাতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেন নিরাপত্তা সংস্থা থেকে ফোন করে বলা না হয় যে কোনো টকশোতে কাকে ডাকা হবে– এই চর্চাটা যেন বন্ধ হয়। খুবই আশার কথা যে ১৭ বা ১৮ বছরের নির্বাসিত জীবন থেকে তারেক রহমান আসছেন। তিনি তার এই নির্বাসিত জীবনটা যুক্তরাজ্যে কাটিয়েছেন। ব্রিটেনের গণতন্ত্র কেমন করে কাজ করে, সেটা তার কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিশেষ করে পত্রিকা, সেটাও তার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমরা আশা করব যে তিনি সেটা এখানে প্রয়োগের সুযোগটা করে দেবেন। আমরা সেটা চর্চা করতে চাই।’

এ ছাড়া নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ, ইনকিলাবের সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দিন, যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার, কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ইউএনবির সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুদুর রহমান খলিলী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম, যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী ফাহিম আহমেদ, বিবিসির জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি কাদির কল্লোল বক্তব্য দেন।

সম্পাদকদের মধ্যে নয়া দিগন্তের সালাহ উদ্দিন বাবর, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের শামসুল হক জাহিদ, দেশ রূপান্তরের কামাল উদ্দিন সবুজ, বাসসের চেয়ারম্যান আনোয়ার আলদীন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব মোর্শেদ, দি ডেইলি সানের রেজাউল করিম লোটাস, সমকালের শাহেদ মোহাম্মদ আলী, আমার দেশের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, খবরের কাগজের মোস্তফা কামাল, জনকণ্ঠের খোরশীদ আলম, প্রতিদিনের বাংলাদেশের মারুফ কামাল খান, ঢাকা পোস্টের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মো. কামরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান ইসমাইল জবিহ উল্লাহ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জিয়া উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, কেন্দ্রীয় নেতা মাহাদী আমীন, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, আতিকুর রহমান রুমন, মীর হেলাল, মোর্শেদ হাসান খান, শাম্মী আখতার, শায়রুল কবীর খান, মাহমুদা হাবিবা, ফারজানা শারমিন পুতুল, শামসুদ্দিন দিদার, খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম শামসুর ইসলাম প্রমুখ।

এএইচআর/এসএসএইচ