চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের লাশ থাকা-না থাকা নিয়ে সংসদে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমপিরা।

বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস বিল, ২০২১’ বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়। বিএনপির সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন ইস্যুটি তোলেন। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির এমপিরা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। জিয়ার লাশ থাকার বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।

বিএনপির সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, জিয়াউর রহমানের লাশ সেখানে (চন্দ্রিমা উদ্যান) আছে কি নেই, তা বড় বিষয় নয়। সেখানে যে লাশ নেই, তা আপনারা (আওয়ামী লীগ) কীভাবে জানলেন? এত বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। এটি নিয়ে আগে কথা বলেননি কেন? এখন কেন বলছেন?

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ইতিহাস বিকৃতি তো বিএনপিও করে। তারা বলে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। আর তিনি (জিয়াউর রহমান) বেঁচে থাকতে নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন, কখনো তা দেখিনি। তাদের প্রথমে ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করতে হবে। তারপর আওয়ামী লীগ যদি ইতিহাস বিকৃতি করে থাকে, তা বন্ধের আহ্বান বিএনপি জানাতে পারে।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, সংসদ ভবন নিয়ে লুই কানের যে নকশা, সেখানে কোথায় রয়েছে যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ দাফন করতে হবে? সেখানে লাশ আছে কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেগম জিয়া স্বামী মনে করে কাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান। তারই উচিত এ প্রশ্ন করা, তার স্বামীর লাশ সেখানে আছে কি না? বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে তা নির্ণয় করা উচিত। আপনারা (বিএনপি) দলের নেতা ভেবে কাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন? ওখানে কি কারো মৃতদেহ আছে?

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, একজন সাংসদ বলেছেন, সঠিক ইতিহাস আসতে নাকি শত বছর লাগে। মৃত্যুর ৪০ বছর পরে সঠিক ইতিহাস বের হলে সমস্যা কোথায়? জিয়াউর রহমানের লাশ আছে কি নেই- তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের ব্যবস্থা আছে। আপনারা (বিএনপি) নিরপেক্ষ একটি কমিটি করুন। সরকার সহযোগিতা করবে। সত্য উদঘাটনে ভয়ের কী আছে?

তিনি বলেন, আপনাদের দলের নেত্রীকে বলুন। যদিও তিনি সাজাপ্রাপ্ত, প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পায় সাজা স্থগিত আছে। আইনে সুযোগ থাকলে তার নেতৃত্বে কমিটি করুন।

বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তার বক্তব্যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ১৯৮১ সালে সংসদ ছিল। সেখানে আওয়ামী লীগও ছিল। মানিক মিয়া এভিনিউতে যে জানাজা হয়েছিল, তাতে সাংসদরা উপস্থিত ছিলেন। শোক প্রস্তাবের ওপর সংসদে দীর্ঘ আলোচনায় তারা অংশ নিয়েছিলেন। সেগুলো প্রসিডিংসের মধ্যে রয়েছে। আমার কথায় যদি কোনো অপ্রাসঙ্গিক তথ্য থাকে, তা এক্সপাঞ্জ করুন।

তিনি বলেন, কারো যদি অপমৃত্যু হয়। তাহলে তার ময়নাতদন্ত লাগে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। সামরিক আদালতে বিচারও হয়েছে। এটি অসত্য নয়। আজ জেনারেল এরশাদ বেঁচে থাকলে তিনি লজ্জা পেতেন। লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকতেন।

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, আর্কাইভস যদি করতে হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন বীর উত্তম। এটি স্বীকার করতে হবে। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তারা তাদের কথা বলবেন। আর আমরা আমাদের কথা। এটুকু ধৈর্য যদি তাদের না থাকে, তাহলে তারা কী ইতিহাস লিখবে? চর্চা করবে? আর্কাইভসে কী জমা, তা ভালো করেই বুঝতে পারছি।

রুমিন বলেন, ইতিহাস সবসময় জয়ীদের হাতে লেখা হয়। আমাদের মতো দেশে প্রকৃত ইতিহাস জানতে শত বছর লাগে। দলীয় চশমায় ইতিহাস লেখা হলে আইন পাস করে কোনো লাভ হবে না। আজ ৪০ বছর পর কেন জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে এ বিতর্ক। সরকারের ব্যর্থতা, ভোট চুরি, গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এ বিতর্ক করা হচ্ছে।

রুমিন ফারহানার বক্তব্যের শেষের দিকে সংসদে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সরকার দলীয় সদস্যরা হইচই করেন। পরে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, আজ ৪০ বছর পর লাশ নিয়ে লাফালাফি করা হচ্ছে। সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমানের লাশ রয়েছে- বিএনপির এমপিরা তা সংসদে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেখানে যে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই, তা ৪০ বছর আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর তার লাশ পরিবারের কেউ দেখেননি। খালেদা জিয়া দেখেননি। তারেক জিয়া লাশ দেখার জন্য কান্নাকাটিও করেছিলেন। শাহ আজিজ একটি চালাকি করেছিলেন- ‘লাশ পাওয়া যাক আর না যাক, একটি বাক্স পাঠিয়ে দাও’। সেই বাক্স পাঠানো হয়েছিল। জনমনে সন্দেহ ছিল, কীসের জানাজা পড়ছি। শুধু বাক্স, নাকি ওখানে জিয়াউর রহমান আছেন?  

বিষয়টি নিয়ে সংসদে দেওয়া নিজের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সেলিম বলেন, ২০ জুন ১৯৮১ সালে আমি সংসদের নতুন সদস্য। জিয়াউর রহমান তখন মারা গেছেন। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সংসদে আমি সরকারের কাছে এটি জানতে চেয়েছিলাম। এটা প্রসিডিংসে আছে। আমি সেদিন বলেছিলাম আপনারা প্রমাণ করুন ওই বাক্সে কোনো লাশ আছে কি না। জনমনের সন্দেহের কথা সেদিন সংসদে বলেছিলাম। আমি দুই দিনের মধ্যে লাশের ছবি ছাপিয়ে জনমনের সন্দেহ দূর করতে বলেছিলাম। আর না পারলে জনমনের সন্দেহই প্রমাণিত হবে। আজ ৪০ বছরেও একখানা ছবি দেখাতে পারেননি। প্রমাণই করতে পারেননি। একখানা বাক্স দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। একটা বাক্স এনে বলেছেন জিয়াউর রহমানের লাশ। এ বিভ্রান্তি দূর হয়ে গেছে। ওখানে যে বাক্সটা আছে তা সরিয়ে লুই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে হবে।

স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, সেখানে বাক্সটি যদি থাকে, তা সরিয়ে দিন। জিয়ার লাশ জায়েজ করার জন্য তিন বড় রাজাকারকে সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে। তাদের কবরও সেখান থেকে সরিয়ে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। মানুষ এসব বিভ্রান্তি মেনে নেবে না।

বিএনপির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখানে লাশ আছে প্রমাণ করুন। এক মাস সময় দিলাম। সে সময় সেনাপ্রধান এরশাদও লাশ দেখেননি। তাহলে কী দিয়ে প্রমাণ করবেন? লাশ নিয়ে আর রাজনীতি করবেন না। ওখানে কোনো লাশ নেই, কিছুই নেই। একটি বাক্স মাটি চাপা দিয়েছে। ৪০ বছর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ক্ষমতায় থেকেও তারা প্রমাণ করতে পারেনি। একটি বাক্সের জানাজা করেছে।

তিনি বলেন, দুই নম্বর রাজনীতি অনেক করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের চিনে গেছে। আর দুই নম্বরি কইরেন না। জিয়াউর রহমান যে অপকর্ম করেছেন, তার পরিণতি দেখুন। লাশ নিয়ে যেন আর সংসদে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া হয়।

এইউএ/আরএইচ/জেএস