বিএনপির অনশন কর্মসূচিতে সেলফি তুলছেন এক কর্মী / ছবি- ঢাকা পোস্ট

বরাবরের মতোই মাঠের কর্মসূচি পালনের সময় চেইন অব কমান্ড ধরে রাখতে পারছে না বিএনপি। শনিবার (২০ নভেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাত ঘণ্টার অনশন কর্মসূচিতে একাধিকবার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রতিবারই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের ধমক দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়।

অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা এবং তাকে বিদেশে পাঠানোর দাবিতে আয়োজিত শুধু এ কর্মসূচি নয়, এর আগেও একাধিক কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী নেতাকর্মীদের ধমক, কখনও-বা বক্তব্য বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে দেখা গেছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের।

সকাল ৯টায় মির্জা ফখরুল ইসলাম অনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে অনশন কর্মসূচি পালন করবেন, কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেন না, উঠে যাবেন না। বসে থেকে কর্মসূচি পালন করবেন

শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ৯টায় মির্জা ফখরুল ইসলাম অনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে অনশন কর্মসূচি পালন করবেন, কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেন না, উঠে যাবেন না। বসে থেকে কর্মসূচি পালন করবেন।

শনিবারের অনশন কর্মসূচিতে ছবি তুলতে দেখা যায় বিএনপির এক কর্মীকে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

তিনি যখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন, তখনই অনশনে অংশগ্রহণকারীরা ‘সেলফি’ আর ‘ফটোসেশন’নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় মির্জা ফখরুল হাত দিয়ে ডায়াসের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ফটোসেশন করা নেতাকর্মীদের সরে যেতে নির্দেশ দেন। অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান মাইকে ফটোসেশনে ব্যস্ত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নায়ক হওয়ার দরকার নাই। এখান থেকে সরে যান। কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল আপনারা এখান থেকে সরে গিয়ে রাস্তায় যান। আর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক আপনি সভাপতির পাশে গিয়ে বসেন। বিকেল ৪টা পর্যন্ত অনশনের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। এটা মহাসচিবের নির্দেশ।’

অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান মাইকে ফটোসেশনে ব্যস্ত নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নায়ক হওয়ার দরকার নাই। এখান থেকে সরে যান। কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল আপনারা এখান থেকে সরে গিয়ে রাস্তায় যান। আর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক আপনি সভাপতির পাশে গিয়ে বসেন

সোয়া ৯টার দিকে আবারও অনশনে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ কেউ এ সময় ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী মাইকে বলেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে আছেন তারা কেউ সংহতি প্রকাশ করতে আসেননি। আজকের কর্মসূচি অনশনের। এরপর কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে থেকে কর্মীরা সরে গেলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে আবারও তারা সেলফি ও ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মুখে হাসি, হাতে ক্যামেরা, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের কয়েকশ গজ পর্যন্ত বিস্তৃত এ অনশন কর্মসূচির প্রতিটি মুহূর্তের চিত্র ছিল এমনই।

অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে আয়োজিত অনশন কর্মসূচি। সেখানে সেলফি আর ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

দুপুর ১২টার দিকে আবারও নেতাকর্মীদের কেউ কেউ ফটোসেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আবার কেউ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি শুরু করেন। কেউবা আবার অনশনস্থল ত্যাগ করতে থাকেন। এতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন মাইক হাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, ‘বিকেল ৪টা পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। আপনারা কেউ যাবেন না।’

আরও পড়ুন >> কর্মীদের হট্টগোলে ক্ষুব্ধ ফখরুলের ধমক

অনশন কর্মসূচির শুরুতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, কর্মসূচিস্থলের আশপাশে কেউ কিছু খাবেন না। কিন্তু অনশনে অংশ নেওয়া সিনিয়র নেতারা ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ড-থানা থেকে আসা নেতাকর্মীরা সকাল থেকেই আশপাশে অবস্থান নেওয়া হকারদের কাছ থেকে শসা, ছোলা-বাদাম ও আনারস খেতে দেখা যায়। অনেককে আবার অলিগলিতে গিয়ে দোকানে বসে চা পান করতেও দেখা যায়। কাউকে কাউকে হোটেলে দুপুরের খাবারও খেতে দেখা গেছে।

অনশন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কেউ কেউ আনারস, বাদাম খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন / ছবি- ঢাকা পোস্ট

নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের পাশের মিডওয়ে হোটেল গলিতে ভ্যান থেকে আনারস কিনে খেতে দেখা যায় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে। তাদের একজনের নাম সালাউদ্দিন। অনশন কর্মসূচিতে এসে কেন খাচ্ছেন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকালে কিছু খাইনি। তাই একটু খাচ্ছি আরকি।’ একই গলিতে দুটি চায়ের দোকানে শতাধিক নেতাকর্মী চা-বিস্কুট খেতে ভিড় করেন। আশপাশের অলিগলিতেও সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে।

অনশন কর্মসূচির শেষ পর্যায়ে অনেকটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা। একদিকে মাইকে কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন, অন্যদিকে নেতাকর্মীরা খোশগল্পে মেতেছেন। কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আবারও মাইকে নেতাকর্মীদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে অনুরোধ জানান শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী।

অনশন কর্মসূচির শেষ বক্তা হিসেবে যখন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য দিতে ডায়াসে দাঁড়ান, তখন নেতাকর্মীরা আবারও স্লোগান দিতে শুরু করেন। তখন তিনি বলেন, ‘দয়া করে স্লোগান বন্ধ করুন।’ এরপরও নেতাকর্মীরা স্লোগান বন্ধ না করলে তিনি বলেন, ‘তোমরাই কথা বলতে থাক, তোমরাই স্লোগান দিতে থাক। আমি বক্তব্য দেব না। নো, নো।’ এরপর মির্জা ফখরুল রাগ করে বক্তব্য দেওয়া বন্ধ করে দেন। পরে নেতাকর্মীরা স্লোগান দেওয়া বন্ধ করলে পুনরায় বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন তিনি।

শুধু আনারস কিংবা বাদাম নয়, কেউ কেউ ছোলাভোনা খেয়ে অনশনের সময় পার করেন / ছবি- ঢাকা পোস্ট  

এমন পরিস্থিতি সম্পর্কে বিএনপির একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দলের চেইন অব কমান্ড ধরে রাখতে না পারার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের নিচতলার মিলনায়তনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত নেতা তরিকুল ইসলামের স্মরণসভায়ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যায়। ওই সময় মঞ্চে উপস্থিত নেতাদের পেছনে কথা বলা এবং দর্শকসারি থেকে স্লোগান দিয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরির মতো ঘটনাও ঘটে।

একাধিক নেতা সেসময় তাদের শান্ত থাকতে অনুরোধ করেও ব্যর্থ হন। মির্জা ফখরুল ইসলামও ব্যর্থ হন। তখন মহাসচিব বক্তব্য দেওয়া বন্ধ করে মঞ্চে নিজের আসনে বসে পড়েন।

একদিকে চলছে বিএনপির অনশন কর্মসূচি, অন্যদিকে হকারদের খাবারের ব্যবসাও জমেছে বেশ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আজ অনশন কর্মসূচি ছিল। এখানে তো স্লোগান দেওয়ার দরকার নাই। তারপরও নেতাকর্মীরা স্লোগান দিয়েছেন। মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে কারণে নেতাকর্মীদের সড়কে দাঁড়াতে নিষেধ করা হয়েছে এবং বারবার তাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

এর আগেও বিভিন্ন কর্মসূচিতে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আসলে কোন সভায় কেমন আচরণ করতে হবে— এসব বিষয়ে নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। সেটা তো এখন সম্ভব হয় না।’

এএইচআর/আরএইচ/এমএআর/