ভাষাপ্রেম হোক নিখাদ
‘যদি আপনি কোনো লোকের সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলেন যা সে বোঝে, তবে তা তার মাথায় যায়। যদি আপনি তার সঙ্গে তার নিজের ভাষায় কথা বলেন তবে তা তার হৃদয়ে যায়।’- কথাটি নেলসন ম্যান্ডেলার। ম্যান্ডেলার কথাটি ধ্রুব সত্য।
কোরিয়ায় থাকা অবস্থায় দেখেছি একটি জাতি কী করে নিজের ভাষা-সংস্কৃতি দিয়ে বিশ্বদরবারে আসন করে নিয়েছে। কোনোদিন দেখিনি কোনো কোরিয়ানকে গর্ব করে ইংরেজি বলতে। তারা ইংরেজি জানেন না তা কিন্তু নয়। তবে অপ্রয়োজনে বলেন না। কোরিয়ানরা তাদের ভাষাকে বিশ্ববাসীর সাথে একটি করিডোর স্থাপনের যোগসূত্র করেছে। ভিনদেশের সাথে চুক্তিভিত্তিক গবেষণাকর্মগুলোও ইংরেজিতে প্রকাশের আগে তারা কোরিয়ান ভাষায় প্রকাশ করে।
বিজ্ঞাপন
একইভাবে বলতে পারি জার্মানির কথা। ইউরোপের অন্যতম অর্থনীতির দেশ জার্মানি। তারাও তাদের ডয়েসকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করেছে। অধিকাংশ জার্মানরা সহজে ইংরেজি বলতে চান না। জার্মানিতে এসে স্বচক্ষে দেখছি। জার্মান বলুন কী কোরিয়ান বলুন- তারা বুঝেছে, সংস্কৃতির অন্যতম রোডম্যাপ হলো নিজের ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া।
মায়ে ব্রাউনের মতে, কে কোন ভাষায় কথা বলে তা থেকে বোঝা যায় তারা কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় যাচ্ছে। আফ্রিকার একটি দেশ সিয়েরালিওন। সেখানকার রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। এর পেছনে অন্যতম কারণ সেখানে শান্তির দূত হয়ে কাজ করেছিলেন, গর্বিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। আফ্রিকায় শান্তি ফিরেয়ে আনার কারণে সে দেশের সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরমধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পর অন্য কোনো রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদা পায়।
বিজ্ঞাপন
তবে সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা প্রচার, প্রসার কিংবা সংস্কৃতির আদান-প্রদানে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু আজও সিয়েরা লিওনের মানুষদের মুখে শোনা যায় বাংলা ভাষা। সিয়েরা লিওনের মানুষেরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদানকে।
কিছুদিন আগে একটি তথ্যচিত্রে দেখছিলাম কীভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার বিকাশ হচ্ছে। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সম্পূর্ণ পৃথক সংস্কৃতির দেশে বাংলায় কথা বলছেন ভিনদেশি নাগরিকরা। বড় বেদনার প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ দরকার তা কি আমরা নিতে পেরেছি?
নিদেনপক্ষে আফ্রিকার দেশগুলোতে বাংলাভাষার কেন্দ্র খুলতে পারতাম আমরা। ভিনদেশের নাগরিকরা যাতে বাংলাভাষা শিখতে পারেন তার জন্য ভালো কোনো অ্যাপস নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, ইউটিউবে ভালো টিউটোরিয়াল নেই, ভালো কোনো কোর্স নেই। এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
মা, মাতৃভাষা ও দেশপ্রেম জিনিসটা আসলে কী বিদেশ না এলে বোঝা মুশকিল। ভিনদেশের হোক, স্বদেশের হোক কাউকে যখন দেখি বাংলায় কথা বলছে, তখন তার সাথে স্বউদ্যোগে পরিচিত হই। অনেক কোরিয়ানকে দেখি বাংলায় কথা বলতে। বিদেশের মাটিতে পথ চলতে কারও মুখে বাংলা শব্দ শুনলে তাকে আপন মনে হয়। বাংলা সাইনবোর্ড লেখা দোকান দেখলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাই। বাংলাভাষী কারো দোকান দেখলে সেখানে বসে আড্ডা দেই।
বর্তমানে, বিশ্বব্যাপী প্রবাসে বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে। সে হিসেবে অনেক বাংলাদেশিরা দোকান, রেস্তোরাঁ দিয়েছেন। সেখানে একে অপরের সাথে বাংলায় কথা বলে শান্তি খুঁজে ফেরেন। পয়লা বৈশাখ, বইমেলা, বাংলা কবিতার আসর, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো হরেক রকমের আয়োজন। এখন প্রবাসেও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল হচ্ছে। অনেক বছর ধরে আমেরিকা, লন্ডনে বাংলা পত্রিকা বেরোয়। বাংলা টিভি, রেডিও চালু হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বাৎসরিক বাংলা ম্যাগাজিন প্রকাশ হয়। বাঙালিরা শিল্প–সাহিত্য–সংগীতের চর্চা করেন প্রবাসেও। বাঙালি পরিবারগুলো সন্তানদের প্রাণপণভাবে বাংলা শেখাচ্ছে।
বাংলা ভাষার জন্য প্রবাসীরা যা কিছু ভূমিকা রেখেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস। এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ বিষয়ে কানাডাপ্রবাসী বাঙালি আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলামের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তারা তাঁদের সংগঠন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিক গোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রথমে ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘে এবং পরে ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
পরে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সক্রিয় সহযোগিতা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি নিয়মানুগভাবে ইউনেসকোর ৩০তম অধিবেশনে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর সেই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ ভবনের সামনে শহীদ মিনার বানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শহীদ মিনার হয়েছে। সাম্প্রতিককালে ফ্রান্সের তুলুজ শহরে প্রবাসীদের প্রচেষ্টায় স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছে। স্থায়ী শহীদ মিনার রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। বিশ্বের নানান জায়গায় শহীদ মিনার থেকে শুরু করে অনেক বাংলা বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাসটি আমাদের বাংলাদেশের। পৃথিবীর বুকে আমরা একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। এখন সময় বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ভাষাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার। এজন্য নিতে হবে যৌক্তিক উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই হোক আমাদের শপথ।
এইচকে