এক.

স্পেনের ছোট্ট শহর সালাউ। দেখে মনে হয়েছিলো ছোট গল্পের মতো এক শহর। ছোট গল্প যেমন শেষ হয়েও শেষ হয় না। সালাউ শহরটির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যও তেমন। দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরলাম ঠিক, তবুও যেনো আরো দেখার বাকি থেকে গেলো। 

সালাউ বার্সেলোনা থেকে দক্ষিণে প্রায় ৮১ কিলোমিটার বিস্তৃত বিশ্বখ্যাত সমুদ্র সৈকত 'কসতা দোরাদা' বা সোনালী উপকূলের একটি অংশ। শহরটি গ্রিক ও রোমান সভ্যতা থেকে ব্যবহার হয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ অবকাশ যাপন ও বিনোদনের জন্য বিখ্যাত বাণিজ্য শহর। গ্রিকদের হাতে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয় শহরটি। ১২৮৬ সালের পরে সালাউ শহরটি হয়ে গিয়েছিলো বড় বড় জলদস্যুদের আবাসস্থল। তখন শহরটিকে একটি অনিরাপদ শহর হিসেবে মনে করা হতো। 

পরে ১৫৩০ সালে আর্চ বিশপ তারাগোনা এই শহরকে দস্যুদের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি প্রতিরক্ষা টাওয়ার তৈরি করেছিলেন। যে টাওয়ারটির নাম ‘তররে ভিলা’। সালাউর পৌরানিক ঐতিহ্যের মধ্যে এই তররে ভিলা অন্যতম। শহরটি তাররাগোনা প্রদেশের অংশ। যেই প্রদেশের উপকূলজুড়ে প্রত্মতাত্ত্বিক স্থানগুলোকে ২০০০ সালের ৩০ নভেম্বর মানব সভ্যতার ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।

ভূমধ্যসাগরের উপচেপড়া সোনালী বালুকাময় সৈকত, অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ আর বিভিন্ন পরসা দিয়ে সাজানো দোকানপাটের এই শহর, বিশ্বজুড়ে ভ্রমণপিয়াসীদের সবসময় আকর্ষণ করে। বাংলাদেশিদের 'ব্যাডমিন্টন গ্রুপ বার্সেলোনা'র আয়োজনে সালাউ যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেলাম আগস্টের শেষের দিকে।

আমাদের ব্যাডমিন্টন গ্রুপের অভিভাবক নজরুল ইসলাম চৌধুরী ভাইয়ের ফোন পেয়ে জানলাম, আমাদের এবারের ট্যুরের পরিকল্পনা। অন্য সময়ের মতো এক দিনের ট্যুর হবে না এবার। সালাউতে আমরা এক রাত থাকবো হোটেলে। দু'দিনের ট্যুর।

কর্মব্যস্ততার বর্ণহীন সময়ে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে সুন্দর আনন্দময় একটা সময় কাটবে ভেবে আনন্দ হলো। যদিও নিজের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এই সফরের সঙ্গী হওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আমার একটু সময়ক্ষেপণ হলো। 

৩ সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সালাউর উদ্দেশে। ৭ পরিবারের মোট ৩৮ জনের গ্রুপ আমাদের।

ফ্যামিলি নিয়ে যাবেন নজরুল ইসলাম চৌধুরী ভাই, দুলাল আজাদ ভাই, শফি ভাই, সোহেল ভাই, উজ্জ্বল ভাই, আমির হোসেন আমু ভাই। এছাড়া শফিক খান ভাই এবং মোক্তার ভাই আমাদের সবার যৌথ পরিবারের বিশেষ সদস্য হিসেবে যাবেন।

স্পেনের মধ্যযুগের আরাগো সাম্রাজ্যের রাজা জাইমে আই (জাইমে প্রিমেরো)-এর নামে নামকরণ করা একটি সুন্দর হোটেল। সমুদ্রের পাশে শহরের মূল অংশে ওই হোটেলে ১১টি রুমের বুকিং করলেন নজরুল ইসলাম ভাই।

হোটেলে চেক ইন করার সময় ছিলো দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে। কাজের ব্যস্ততা সেরে লেট-নাইটে ঘুমিয়ে সকালে বের হতে দেরি হয়ে গেলো আধাঘণ্টা। বেলা সাড়ে ১১টায় গাড়িতে উঠলাম। সবাই যার যার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে যাবে। বার্সেলোনা থেকে সালাউ যেতে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। 

নিজের গাড়িতে নতুন ড্রাইভার আমি। সঙ্গে আমার স্ত্রী আর তিন সন্তান। আমাদের গ্রুপের সবাই যে যার সুবিধাজনক অবস্থান থেকে পথ পাড়ি দিয়ে সালাউ যাবে। আমি আর উজ্জ্বল হাসান ভাই আলাদা-আলাদা গাড়িতে একই সময়ে সামনে-পেছনে থেকে হাইওয়ে ধরে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু হাইওয়ে দেখি আরেক 'ফুলসিরাত'।

ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে কোনো ভুল না করে সঠিক রুটে গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাটা আমার মতো নতুন চালকের জন্যে একটু কঠিনই হওয়ার কথা ছিলো। হলোও তাই।

হাইওয়েতে (অটো পিস্তা) ঢুকেই উজ্জ্বল ভাইকে হারিয়ে ফেললাম। নিজের পথ নিজেকেই পাড়ি দিতে হবে। নিজের ফ্যামিলির পুরো দায়িত্ব নিয়ে ছুটে চললো আমার গাড়ি। কতো পথ-প্রান্তর পাড়ি দিয়ে চলছি আমরা। হাইওয়ের এক পাশে বিস্তৃত নীল ভূমধ্যসাগর, অন্য পাশে সবুজ পাহাড়, আর দিগন্ত খোলা আকাশ।

গাড়ির স্টিয়ারিং এ বসে কেউ কোনোদিন মনে মনে কবিতা কিংবা গল্পের প্লট তৈরি করেছে কি না জানি না। তবে গাড়ির স্টিয়ারিং ঠিক রেখে এই লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে, প্রকৃতির এই বিস্তৃত সৌন্দর্যকে অবহেলাই করেছে আমার চোখ। দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সালাউ পৌঁছলাম। তখন দুপুর দেড়টা। ঠিকানা অনুযায়ী হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে ইতস্তত করছিলাম। 

আমাদের গ্রুপের অন্যতম সদস্য শফিক খান ভাই হোটেলের লাউঞ্জ থেকে নাম ধরে ডাক দিলেন। অপরিচিত শহরে, প্রথম পরিচিত কণ্ঠ শুনলাম। কিন্তু ওনাকে মানুষের ভিড়ে দেখতে পেলাম না তখনই। পরে খান ভাই এগিয়ে এসে সহযোগিতা করলেন আমাকে। আমার হোটেল রুমের চেক ইন শেষ হলো।

হাইওয়ের দ্রুতগতি, আর গোলক-ধাঁধায় হারিয়ে ফেলা উজ্জ্বল হাসান ভাইকে এর মধ্যে ফোনে পেয়ে গেলাম এই শহরে। আমি বেরিয়ে গিয়ে ওনাকে রিসিভ করলাম। তারপর যার যার রুম খুঁজে নেওয়ার পালা। রিসিপশনের সুন্দরী মেয়েটি আমার হাতের কব্জিতে পুলসেরা পরিয়ে দিলেন। আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যে 'রাখী বন্ধন' পরিয়ে দেওয়ার মতো। টেকনোলজির কারিশমাতে হোটেল রুমের চাবি হাতে দেওয়ার ঐতিহ্য এখন শেষ হয়ে গেছে। পুলসেরা’টির ভেতরে আসলে কন্টাক্টলেস টেকনোলজি এনএফসি চিপ বসানো। 

হোটেলের দোতলায় আমার রুম খুঁজে পেলাম। দরজার লকারে স্পর্শ না করে, কব্জি ঘুরিয়ে পুলসেরাটি কাছে নিলাম। সবুজ আলো জ্বলে দরজা খুলে গেলো। ভাবছি স্পর্শ না করে কাজ হাসিলের এই টেকনোলজি আমাদের না জানি কোথায় নিয়ে যাবে। আমাদের হোটেল রুমটি সুন্দর ছিলো। বারান্দার লম্বা গ্লাসের দরজা। দরজা ঠেলে দক্ষিণমুখী বারান্দার ভিউটা দেখে মন জুড়িয়ে গেলো। 

নীল জলের কৃত্রিম ঝরনা, সুইমিং পুল, আর অ্যাকুয়াটিক পার্কে মনোমুগ্ধকর ইভেন্টের দৃশ্য। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিস্তৃত নীল আকাশের সৌন্দর্য। মনে মনে ভাবলাম, ঘুরতে আসাটা স্বার্থক হলো। এমন সুন্দর বারান্দা বন্ধ রাখা যায় না। ‘আজি খুলিয়া দিলাম দখিনের দ্বার।’ গ্রীষ্মের দুপুর সালাউতে। রুমের গরমে হাঁসফাঁস করছিলাম। ভ্রুকুটি করে এসি চেক করলাম। এসি কাজ করছে না। গেলাম রিসিপশনে। বললাম, এসি কাজ করে না।

সেই মেয়েটি মুখে মুচকি হাসি টেনে বললো- বারান্দা খোলা তোমাদের? মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলাম- হ্যাঁ। বুঝলাম, মেয়েটি আমার অভিযোগ শুনেই সমস্যা বুঝে গেছে। মেয়েটি বললো, বারান্দা খুললে অটোমেটিক এসি বন্ধ হয়ে যায়। রুম সেন্সর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসি বন্ধ করে দেয়। 

উঠে এসে দখিনা দ্বার টেনে দিলাম। এসির বাতাসে ঠান্ডা হলাম কিছুক্ষণ। তারপর ক্ষিধে লাগলো প্রচুর। সঙ্গে আনা দুপুরের খাবার খেলাম। বাচ্চারা হই-হুল্লোড় শুরু করলো, বারান্দা দিয়ে অ্যাকুয়াটিক পার্ক দেখে। 

ব্যতিব্যস্ত হয়ে নেমে পড়লাম আমরা। স্বচ্ছ-নীল পানির নাচানাচি দেখে বাচ্চাদের আর নিয়মে বাঁধা গেলো না। পানিতে দৌড়-ঝাঁপ, সাঁতার শুরু হলো। কে আর কাকে ঠেকায়! নারীরা ছাড়া আমরা পুরুষরাও বাচ্চা হয়ে গেলাম তখন। উঁচুতে উঠে ওয়াটার স্লাইডসে পিচ্ছিল খেতে খেতে নিচে পড়তে লাগলাম। 

ওয়াটার স্লাইডসের উচ্চতা দেখে আমার বড় মেয়ে তাসমীম কিছুটা থমকে গেলো। বলে-কয়ে কনভিনস করলাম। একবার স্লাইডস করার পর আর মেয়েকে থামানো গেলো না। বার বার স্লাইডস করছে। আর ছোট মেয়ে তানহা স্লাইডস ইভেন্টে আটকা পড়লো পর্যাপ্ত উচ্চতা না থাকার কারণে।

আমার ৪ বছরের ছোট মেয়েকে বুঝ মানাতে পারলাম না। কান্নায় দু'চোখ উপচে পানি পড়তে লাগলো। জলের খেলায় এসে, নিজেই চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলো। আমি কোলে তুলে ছোট ইভেন্টগুলোতে নিয়ে ওর মন খুশি করে দিলাম। পরে বাচ্চাদের অনেক টানাটানি করে পানির রাজ্য থেকে হোটেলে আনলাম।

সবাই ক্লান্ত। শেষ বিকেলে হালকা ঘুম হলো। নজরুল ইসলাম ভাই, এর মধ্যে ফোন দিয়ে খবরা-খবর নিলেন। বাইরে বের হয়ে শহরটি ঘুরে বেড়াবো বলে নামলাম। হোটেলের লাউঞ্জে এসে দেখি ঝুম বৃষ্টি! একেবারে বজ্রসহ মুষলধারায় বৃষ্টি। ইন্টারনেটে আবহাওয়া চেক করলাম। সন্ধ্যা ৮টার পর থেকে বৃষ্টি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই নিচে অপেক্ষা ছাড়া উপায় রইলো না। 

বাচ্চারা সবাই নিচে। হোটেল লাউঞ্জের পাশেই বিশাল হল রুম। সেখানে বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন খেলার পসরা সাজানো। সব বাচ্চারা সেখানে খেলছে। আমরা বৃষ্টি-সময়ে ধোঁয়া তোলা কফি খাচ্ছিলাম হোটেলের ক্যাফেটেরিয়াতে বসে। এক ফাঁকে দেখে এলাম বাচ্চাদের। বন্ধুত্ব পাতিয়ে গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা খেলছে। আর মেয়েরা দেখলাম এক গ্রুপ হয়ে আপন মনে ছবি আঁকছে। 

এক সময় কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে মাত্র উঠলাম। এ সময় আমার ছোট মেয়ে তানহা দৌড়ে আমাকে ঝাপটে ধরলো। হাতে এতোক্ষণ ধরে তার আঁকা কাগজ। আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। কাগজ খুলে আমার মনটা ভালোলাগায় ভরে গেলো। ইংরেজিতে সুন্দর করে আর্ট করে লিখেছে- 'আই লাভ ইউ বাবা’। সঙ্গে একটি হার্ট আঁকা। জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলাম মেয়েকে। ছোট শিশু সে। আপন মনে খেলতে গিয়ে তার সব ভুলে থাকার কথা। অথচ আমার ছোট্ট মেয়েটি খেলার ছলেও বাবাকে মনে রেখেছে। সত্যি, সন্তান পরিবার নিয়ে কতো সুন্দর জীবন আমাদের। 

বৃষ্টি থামার নাম-গন্ধ নেই। আমরা দু'টো গাড়িতে করে নেমে গেলাম শহর ঘুরতে। নজরুল ইসলাম ভাইয়ের গাড়িতে আমি, শফি ভাই, সোহেল ভাই। অন্য গাড়িতে শফিক খান ভাই, উজ্জ্বল ভাই, ফয়সাল ভাই, মোক্তার ভাই। ঘুরতে এসে বৃষ্টির আক্রমণে পড়াটা বিরক্তিকর হয়। কিন্তু ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মনে হলো, আমরা বৃষ্টি-বিলাস করছি। 

নজরুল ভাই গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে। মৃদুস্বরে গান চলছিলো। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজের সঙ্গে গানের সুরে মিশে অদ্ভুত সুন্দর হয়ে উঠলো সময়টি। উইন্ডশিল্ডের বৃষ্টির পানি মুছতে মুছতে গাড়ি এগিয়ে চললো। 

সন্ধ্যার আবহে আলো জ্বলছে শহরময়। কিন্তু আলোর তীব্রতা অনেক সহনীয়। মিষ্টি আলোতে বৃষ্টির মাখামাখি। সোনালী দ্যুতি ছড়াচ্ছে চারদিকে। শহরটিকে আমার ছবির মতো সুন্দর মনে হলো। অনেক গোছানো ও পরিচ্ছন্ন শহর। দুই পাশের বিপনিবিতানগুলো দেখলে সহজেই বোঝা যায়, এই শহর পর্যটকদের। 

অসংখ্য রেস্তোরাঁ দুই পাশে। বিভিন্ন দেশের খাবার পাওয়া যায়। সবগুলোর বিশেষত্ব আলাদা-আলাদা মনে হলো। ইন্টেরিওর ডেকোরেশন ডিজাইন, লাইটিং খুবই মনোমুগ্ধকর। বিপনিবিতানের পাশাপাশি দু’পাশে সুন্দর সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখলাম। উঁচু ভবনের ভারে ন্যুব্জ হওয়া শহর নয় সালাউ। শহরের সৌন্দর্যে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্য শহরের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা খুব নিয়ন্ত্রিত মনে হলো। 

শহরের ভেতরেও সবুজের সমারোহ দেখলাম। রাস্তার দুই পাশে আবাসস্থলের সামনের লনে বিভিন্ন প্রজাতির সুন্দর সুন্দর গাছ। ঘুরতে ঘুরতে সমুদ্রের পাশাপাশি চলে এলাম আমরা। ফিরতি পথে যাওয়ার সময় দেখলাম এক দিকে রাস্তা সাময়িক বন্ধ। গাড়ির পেছন সিট থেকে একটু উঁচু হয়ে দেখলাম- সামনের রাস্তাময় সাদা রাজহাঁসের সারি। এক কিষাণীর হাতে লাঠি, সে রাজহাঁসের পাল নিয়ে বাসায় ফিরছে। এজন্য রাস্তা সাময়িক বন্ধ। 

রাতের সালাউকে আরো বর্ণময় করে তুলে ফন্ট লুমিনোসা (আলোকোজ্জ্বল ঝরনা)। এর ঝরনার নকশাও তৈরি করেছেন বার্সেলোনা শহরের বিখ্যাত ‘ফুয়েন্তে মাখিকা দে মনজুইক’ (মনজুইকের জাদুর ঝরনা)-এর রূপকার আর্কিটেক্ট কার্লস বুইগাস।

মূল শহর গাড়ি চেপে দেখতে আমাদের এক ঘণ্টার মতো লাগলো। শহরটি বেশি বড় নয়। আয়তন মাত্র ১৫ বর্গকিলোমিটার। স্থায়ীভাবে বসবাস করা মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম। জনসংখ্যা মাত্র ২৭ হাজারের মতো। বাকি যে মানুষজন আছে তারা সবাই ক্ষণিকের অতিথি। আমাদের মতো বিনোদন-প্রিয় ঘুরতে আসা মানুষ। আনন্দ করে, মনের মধ্যে স্মৃতি পুরে যে যার গন্তব্যে ফিরে যাবে। মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পর্যকদের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। 

আমাদের গ্রুপের সবাই একসাথে ডিনার করলাম হোটেলের বুফেতে (সোজা বাংলায় পেট চুক্তি খানা)। খাওয়ার ছড়াছড়ি বিশাল রেস্তোঁরা জুড়ে। যে যা ইচ্ছে যতটুকু ইচ্ছে খাবে। সেই রাতে মোট সাড়ে তিন হাজার মানুষ ডিনার করবেন এই বুফেতে। সংখ্যাটা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। 

রাতের খাওয়া শেষ করে রুমে গেলাম। সারাদিনের ক্লান্তি চোখে-মুখে ভর করলো। নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে একটি নতুন সকাল পাবো আশা ঘুমিয়ে পড়লাম। 

দুই.

একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙলো। আমি, ফয়সাল ভাই আর উজ্জ্বল ভাই নিজেদের পরিবার নিয়ে বের হলাম। সকালের নাস্তা করবো। সমুদ্রের পাড়ে একটি রোস্তোরাঁর সামিয়ানার নিচে বসে দারুণ এক ব্রেকফাস্ট হলো আমাদের। এবার শহর ঘোরার জন্য ট্যুরিস্ট ট্রেনে উঠবো। নামেই ট্রেন, ট্রেনের আদলে গড়া রাস্তায় চলা গাড়ি। তবে সুন্দর খুব। হুইসেল বেজে ট্রেন চলা শুরু হলো। এক ঘণ্টার মধ্যে শহরের সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমরা।

গ্রীষ্মের দুপুর তেঁতে উঠেছে। এবার সমুদ্রে যাবো। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সোহেল ভাই। সালাউর সবচে সুন্দর রাস্তা হলো বুলেভার্ড জাউমে আই। সমুদ্রের পাড় ধরে চলে গেছে এই প্রশস্ত রাস্তা। পার্কের আদলে গড়া রাস্তা। লম্বা পাতা চারপাশে ঝুলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাম গাছ। রাস্তার উচ্চতা প্রায় সমুদ্র লেভেলের সমান। কিছু দূর অন্তর-অন্তর রাস্তায় আড়াআড়ি ঢালু করে ক্যানেল করা আছে। সমুদ্রের জোয়ার হলে পানি চলে আসে এই পথে। 

এই পথ ধরে একটু দক্ষিণে এগোলেই রাজা জাইমে আইয়ের স্মৃতিস্তম্ভ। রাজামশায় জাহাজের সামনের ঘোড়া-মুখের মাস্তুলের ওপর দাঁড়িয়ে ডান বাহু পেট বরাবর ভাঁজ করে ডানদিক ঘাড় ঘুরিয়ে অনড় তাকিয়ে আছেন, পেছনে জাহাজের বাদাম তোলা। আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখলাম, সমুদ্রের তীর বরারবর, মানুষ-সমান উচ্চতা থেকেও বড় বড় রঙিন হরফে লেখা SALOU। এই দুই জায়গায় ছবি তুললাম সবাই। 

ফয়সাল ভাই, আর সোহেল ভাই আমাদের জন্যে ম্যাকডোনালডস থেকে দুই হাত ভরে বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, সফট ড্রিংকস নিয়ে এলেন। মসৃন কার্পেটের মতো সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়ে দুপুরের ক্ষিধা তাড়ালাম আমরা। এবার সমুদ্র স্পর্শ করার সময়। আমরা সমুদ্র পাড়ের মিহি বালি মাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। আকাশ-সমুদ্র দিগন্ত মিশে গেছে আমাদের দৃষ্টির শেষ সীমানায়। সমুদ্র আমাদের ডাকছে। 

সালাউর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে সমুদ্র সৈকত আর তার পাশে ছড়ানো উপকূলের অংশ। পর্যটকরা মূলত সর্বাগ্রে এখানে আসেন সৈকতের উদ্দেশে। ইউনেস্কোর ভাষ্য মতে, এই উপকূলটি পরিবেশগত দিক থেকে পরিচ্ছন্ন অঞ্চল। এখানকার জল পরিষ্কার, কোনো বিপজ্জনক জেলিফিশ নেই। সৈকত জুড়ে মিহি বেলে মাটিতে পা দেবে যায় না। সর্বাধিক জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত ‘লেভান্তে’ তে আমরা গেলাম। এটি রাজা জাইম আইয়ের বুলেভার্ড বরাবর অবস্থিত। এছাড়া আছে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত ‘কালা লেঙ্গুয়াদেতস’। যাকে বলা হয়- ‘জনকোলাহল ছেড়ে দূরে থাকা প্রশান্তির জায়গা’।

নগরীর সৈকতে সূর্যস্নানের পরেই সাধারণত পর্যটকরা পোর্ট আভেন্টুরায় যান। এখানে উল্লেখ্য, বিখ্যাত পোর্ট আভেন্টুরা এই সালাউ শহরে অবস্থিত। পোর্ট আভেন্টুরা পার্কটি জনপ্রিয়তা ও আকারে পৃথিবীর মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছে। সৈকতে মিহি বালির উপর স্বচ্ছ পানি। পাড় থেকে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটু সমান পানি। অনায়াশে হেঁটে চলে যাওয়া যায়।

আমাদের ছোট বেলার বর্ষার বিলের হাঁটুজল পানির মতো। আমার বাচ্চাগুলো হাঁসের বাচ্চার মতো ছোটোছুটি করতে লাগলো। তিন জনই এ বছর নতুন সাঁতার শিখেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে নিজেদের ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমি ওদের সাহায্য করছি। এভাবেই কেটে গেলো দুপুর। 

বেলা পড়ে আসছে। এবার বাসায় ফেরার প্রস্তুতি। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করলাম আমি, ফয়সাল ভাই, আর সোহেল ভাই। ফেরার পথে যাত্রা শুরু। শহরের নিয়ন্ত্রিত গতিবেগে আস্তে আস্তে শহর ছাড়ছি আমরা। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ বসে যেটুকু শেষ দেখা দেখে নেওয়া যায়। পরে হাইওয়েতে (অটো পিস্তা) ঢুকে পড়লাম। লাফিয়ে বাড়ছে গাড়ির গতি। ছুটছি আমরা, ছুটছে জীবন। ফিরছি ঘরে, পেছনে ফেলে রেখে স্বল্প সময়ে চেনা সুন্দর সেই সালাউ শহর। 

জেডএস