রাজনৈতিক আশ্রয়ে বিশ্বের অনেক দেশে বসবাস করছেন অন্য দেশের নাগরিকরা। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা দেশে। কিন্তু ভুয়া তথ্য দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হুমকির মুখে পড়েছে।

খোদ ইউরোপ, আমেরিকার পাশাপাশি কোরিয়ায় ব্যাপক হারে বেড়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়। অনেকেই শ্রম ভিসায় কোরিয়ায় গিয়েও রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন, করছেন। অথচ কোরিয়ায় যাওয়ার আগে তাদের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডই ছিল না। আবার কেউ কেউ দেশে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, কিন্তু বিদেশে গিয়ে জামায়াত-বিএনপি পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ভিসা প্রার্থনা করছেন।

সরকারের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সরকারের হাতে এমন বেশকিছু ব্যক্তির বিষয়ে খবর এসেছে, যারা কোরিয়ায় এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) শ্রম ভিসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন।

অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক আশ্রয় বিষয়টি সব সময়ই সে দেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে। কারণ এর ফলে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নেয় আবেদন গ্রহণ করা দেশ। তারা আরও বলছেন, এ কারণে দেশগুলোর শ্রমবাজারেও প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের জন্য। তবে প্রকৃত কেউ দেশে  রাজনৈতিক সমস্যায় থাকলে তা ভিন্ন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো রাজনৈতিক ভিসায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিন্তু এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক থাকায় বিষয়টির প্রভাব পড়ে বিস্তর। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ইপিএস সংখ্যা বৃদ্ধিতে যখন সরকার দেন দরবার করে, তখন কোরিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয় অনেক বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয় ভিসায় বসবাস করছেন।

কোরিয়াতে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয় ভিসা আবেদনের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে বাংলাদেশি মোট ১৪৫৬ জন রাজনৈতিক ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন। আরেকটি চিত্রে দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩ বছরে আবেদনকারীর সংখ্যা ১৬৪৩ জন, যা গত ২৩ বছরে আবেদনকারীদের চেয়েও ১৮৭ জন বেশি। 

কোরিয়ার পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, বাংলাদেশিদের মধ্যে ১১ শতাংশ লোকই এই আবেদন করেছেন, যা একই নিয়মে সাজানো।  রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। দেশে একটি স্থিতিশীল সরকারও আছে। অনুসন্ধান বলছে, আবেদনের প্রায় ১০ শতাংশই ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়ে ভিসা করেছে। অনেকেই ক্ষমতাসীন সরকারের  বিরুদ্ধে ডকুমেন্ট দিয়ে ভিসা নিয়েছেন। তারাই অন্যদিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের সুনাম করছেন। ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সাংসদদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি মিটিং করছেন। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে নাজুক নয়। 

আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছে অনেক পরিচিত মুখ, কেউ কেউ বৃহৎ কমিউনিটির দায়িত্ব পালন করেছেন, কেউ কেউ সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। কেউ কেউ ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়েছিলেন, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় বুঝতে পারায় রাজনৈতিক ভিসায় আশ্রয় নিয়েছেন। এসব কিছু খোদ কোরীয় গোয়েন্দা সংস্থার নখদর্পণে। 

আবেদনের ধরন দেখে বোঝা যায়, অধিকাংশই সাজানো ফাইল। প্রকৃত ভুক্তভোগীরা যারপরনাই সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন। অনুসন্ধান বলছে, ইপিএস ভিত্তিক কমিউনিটির সাবেক নেতৃবৃন্দের সার্টিফিকেট জালিয়াতি, কয়েকজন বাংলাদেশির হুন্ডি ব্যবসা, কিছু সংখ্যক ই৯ ভিসাধারীর অতি লোভ, দূতাবাসের ইপিএস সংশ্লিষ্ট শ্রম বিভাগের ইপিএস কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগে গ্যাপ, ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি- এসব নেতিবাচক কর্মে ইপিএস কর্মীদের বার্ষিক কোটাতেও প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। এ পর্যন্ত দেশটিতে বসবাসরত প্রায় তিন হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী পরিচয় দিয়েছেন বলে সরকারের কাছে তথ্য এসেছে।

সূত্র জানায়, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন তাদের নামে দেশে একাধিক রাজনৈতিক মামলার কথা। দেশে ফিরলেই পুলিশ তাদের আটক করবে, জেলে পুড়বে। কোরিয়ায় মামলার স্বপক্ষে তারা বিভিন্ন কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন।

ইপিএস স্কিমের আওতায় নির্ধারিত সময় কাজের চুক্তিতে দেশটিতে স্থায়ীভাবে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তবে ডি৮ ভিসা, ই৭ ভিসায় পরিবর্তন করে থাকার সুযোগ আছে। অনুসন্ধান বলছে, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে তারা রাজনৈতিক ভিসায় ভিড় করছেন। তবে সরকারের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এতে দেশটির শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সামনে আরও পড়তে পারে।

বাংলাদেশের প্রবাসীরা রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। কোরিয়ায় যারা বৈধভাবে ইপিএস ভিসায় গিয়েছেন, তারা নির্দিষ্ট মানদণ্ড, নির্দিষ্ট ইপিএস স্কিমের আওতায় জব পারমিট পেয়েছেন। তখন তাদের কোনোরকম রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। 

এখন তাদের রাজনৈতিক কর্মী পরিচয় অবশ্যই ভুয়া বলে মনে করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। সরকারের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দূতাবাস, প্রবাসী ও বৈদেশিক  কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বোয়েসেল ইপিএসের বাজার সুরক্ষায় সদা তৎপর। অন্যদিকে বর্তমান রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে কোরিয়ার সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে বাবার অনুরোধ করছেন। শ্রম বাজার সুরক্ষায় নানামুখী ইতিবাচকধারা অব্যাহত রেখেছেন রাষ্ট্রদূত।

এসএসএইচ