ডা. এম ওয়াই এফ পারভেজ

চিকিৎসা একটি অনন্য শিল্প। একে প্রায়োগিকভাবে রপ্ত করতে হয়, বিস্তর জানতে হয়, হৃদয় ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে আত্মস্থ করতে হয়। সব কাজের মধ্যে যেমন প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণি আছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যেও তাই। সবকিছু ছাপিয়ে চিকিৎসকের উত্তম ব্যবহার, আন্তরিকতা, সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগ হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। 

প্রিয় পাঠক, আমি আপনাদের করোনাকালের এক হৃদয়বান চিকিৎসকের গল্প শোনাব। করোনাকালের প্রথম দিকে স্তব্ধ পুরো পৃথিবী। চারিদিকে মানুষের পলায়নপর অবস্থা। ঘরবন্দি মানুষ। চারিদিকে করোনা আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা। গণমানুষের অভিযোগ, এমন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা। সারাদেশের মতো একই চিত্র বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও। 

ডা. এম ওয়াই এফ পারভেজ 

কিন্তু চট্টগ্রামকে কিছু মানবিক চিকিৎসক আগলে রেখেছেন, এই দুঃসময়ে দুর্যোগেও জীবনের অন্তিম ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা সেবায় নিজেদেরকে বিভোর রেখেছেন। শোনাব দরাজ দিলের একজন মানবিক চিকিৎসকের কথা। 

চট্টগ্রামের চিকনদন্ডী এলাকার মোহাম্মদ ইসহাক ও সেলিনা আকতারের জ্যেষ্ঠ পুত্র তিনি। ডা. এম ওয়াই এফ পারভেজের করোনার দিনে দেবদূত হলেন যিনি। করোনা অতিমারিতে দুর্যোগে যেখানে অধিকাংশ চিকিৎসক পলায়নপর ভূমিকায় ছিলেন, সেখানে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে প্রথম থেকেই নিয়মিত রোগী দেখেছেন, দেখছেন ডা. পারভেজ। আমানবাজারের এস এ সেন্টারে গরিবের চিকিৎসকখ্যাত এই চিকিৎসক। সকাল, সন্ধ্যা, মধ্যরাত- যখনই যাই চোখে পড়ে রোগীর ভিড়। রোগীরাই যেন আত্মার আত্নীয়। কী করোনাকাল, কী স্বাভাবিক অবস্থা। সুন্দর মোলায়েম ব্যবহার দিয়ে রোগীদের সাথে কথা বলে, দীর্ঘক্ষণ সময় দিয়ে রোগীর অব্যক্ত কথা শোনেন। 

ডা. এম ওয়াই এফ পারভেজের সঙ্গে ওমর ফারুক হিমেল

এই দেবদূত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে গত বছরের ১ জুন করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ভর্তি হন হাসপাতালে।  সেসময় তার ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের শরীরের অবস্থাও খারাপ ছিল। ২০২০ সালের ৬ জুন হাসপাতাল থেকে পিপিই পরে মাকে একবারের জন্য দেখতে বাসায় আসেন এই দেবদূত। সেখানে চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন প্রিয় জননী। এর একবছর আগে বাবাকে হারান তিনি। মাকে শেষ বিদায় জানিয়ে আবারও ফিরে গেলেন হাসপাতালে, পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন মানবতার ফেরিওয়ালা চিকিৎসক পারভেজ। 

পুরো চট্টগ্রাম যখন অক্সিজেনের  সংকট ছিল, যখন মানুষ হাহাকার করছে, তখন ব্যক্তিগতভাবে ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে শ্বাসকষ্টে ভোগা গরিব রোগীদের সেবা দিলেন। এভাবেই করোনা দুর্যোগের সময় সেবা প্রদানের মাধ্যমে অনন্য নজির স্থাপন করেন  ডা. পারভেজ।

চিকনদন্ডী এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ হাসান মাসুদ মেম্বার বলেন, উহানের আকাশের অদৃশ্য এক অনুজীব পুরো পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে ভাবিয়েছিল, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল মুখ থুবড়ে পড়া মানবিকতা। পুরো পৃথিবীর মানুষের পাশাপাশি, আমি আমরা ক্ষতবিক্ষত মানবতা আমরা দেখেছি প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি কর্তব্যকর্মে আত্মগোপন করা মানুষ। 

সবাই যেন নিজেকে বাঁচাতে চায়। স্বামী তার প্রিয়তমাকে, সন্তান তার মাকে ছেড়ে পালিয়েছিল। এই সব কিছুর ভিড়ে আমরা আমান  বাজারে এক দেবদূতকে দেখেছি তার নাম ডা. পারভেজ। করোনা অতিমারিতে তিনি অত্যন্ত ভালোভাবে রোগীদের সেবাযত্ন করেছেন,  বিশুদ্ধ চিকিৎসক হিসেবে করোনাকালে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। 

আমানবাজার এলাকার কৃতিসন্তান কোরিয়াপ্রবাসী মোহাম্মদ হাসান বলেন, আমার পরিবারের লোকজন সবসময় উনার কাছে চিকিৎসা  করান। উনার চিকিৎসাপদ্ধতি, সুন্দর ব্যবহারে আমার পরিবারের সবাই সন্তুষ্ট। 

আমান বাজারের কদলখানবাড়ীর সুপরিচিতমুখ ছাত্রনেতা সাহেদ মিজান বলেন, ডা. পারভেজ সম্পর্কে আমার খালাত ভাই। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আশৈশব পরোপকারী মানুষ ছিলেন। তিনি চিকিৎসক হিসেবে করোনাকালে যে মানবিক নজির স্থাপন করেছেন, তা অত্র এলাকার মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ভাস্বর। তাছাড়া তিনি স্বজন, অসহায়, নিঃস্বদের কাছ থেকে কখনও চিকিৎসার ফি নেন না।নিজেকে এই পথে বিলিয়ে দিয়েছেন দরাজদিলে। 

কথা প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে চিকিৎসক পারভেজ বলেন, এলাকার  সবার ভালোবাসায়, মা-বাবার অনিঃশেষ দোয়ায় আজ আমি চিকিৎসক। সকলের বিপদে-আপদে দুর্দিনে পাশে থাকা আমার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। 

ডা. পারভেজের ছোট ভাই ডা. সাইফুল ইসলাম ফিরোজ খান বলেন, আমার বড় ভাই সবসময় এলাকার মানুষের কথা চিন্তা করেন।তিনি সার্বক্ষণিক ভাবেন গরিব-নিঃস্ব মানুষের কথা। পাশাপাশি আমাদের সুশিক্ষার পেছনেও উনার অবদান রয়েছে। 

ডা. ফিরোজ আরও যোগ করেন, একজন চিকিৎসক এই বিপদের দিনে ঘরে বসে থাকতে পারেন না। সেটা আমার পিতৃতুল্য ভাই প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, করোনার দুঃসময়ে চিকিৎসকরা মানবিক ত্রাতা।

এইচকে