মা-বাবার সঙ্গে সামিউল

সামিউল তখন প্রাথমিকে পড়ে। এ সময় মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেয় বোন নুরানী। কিন্তু নুরানীর পায়ে জন্মগতভাবে সমস্যা ছিল। এলাকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক জানান নুরানীর চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা লাগবে। এ সময় মা-বাবার বোবা কান্না দেখেছেন সামিউল। দেখেছেন সন্তানের চিকিৎসা করাতে না পারায় মা-বাবার কষ্ট। সেই থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন জেঁকে বসে সামিউলের মধ্যে। ডাক্তার হয়ে বোনের চিকিৎসা করাবেন তিনি।

সেই স্বপ্ন ধরা দিয়েছে সামিউলের কাছে। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ২৭০০তম হয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুযোগ পেয়েছেন। ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে সামিউল পেয়েছেন ৭০.৫ নম্বর। তবে টাকার অভাবে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কৃষক বাবার ছেলে সামিউলের।

সামিউল বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম গাংগইটের দরিদ্র কৃষক সানোয়ার হোসেন ও গৃহিণী নাজিরা বিবির সন্তান। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সামিউল বড় আর বোন নুরানী জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী।

পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে খেতের কাজে সাহায্য করা ছিল সামিউলের অন্যতম কাজ। পাড়ার অন্য ছেলে-মেয়েদের মতো অবসর পাননি তিনি। বাবাকে সাহায্য আর বোনকে পড়ানো ছিল তার কাজ।

স্থানীয় ধারিয়া গাংগইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি, কিচক দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি ও এসএসসি এবং সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন সামিউল। সামিউল পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি সকল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন।

সামিউলের বাবা সানোয়ার হোসেন বলেন, হামার ছোল ডাক্তরি পড়বি এডা কুনুদিন ভাবিনি। হামাকেরে বংশোত কেউ ডাক্তারি বা ইন্জিনিয়ারি পড়েনি। হামি কৃষাণ, হামাকেরে সপনোত আচলোনা ছোল ডাক্তার হবি। আপনেরা দোয়া করবিন, ছোল যাতে ডাক্তরি পাস করে গরিব মানষের চিকিৎসা করবার পারে। হামার সামর্থ্য নেই। তারপরও চেষ্টা করমো যাতে হামার ছোলডা পড়াশোনা করে।

সামিউলের মা নাজিরা বিবি বলেন, হামার ছোল ছোটোত থ্যাকা ডাক্তরি পড়বি সেডা সপনো আচলো। হামি কচি, তুই পড় বাবা ভাল করে। ডাক্তর না হলেও ভাল মানুষ হবার পারবু। হামাকের আত্মীয়-স্বজন কেউ বেশি পড়বার পারেনি। হামার ছোল ডাক্তরি পড়ার সুযোগ পাচে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তুমি হামার ছোলের মনের ইচ্চা পূরণ করো।

সামিউলের ছোট বোন নুরানী এখন স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।

সামিউল বলেন, ছোটবেলায় বোনের চিকিৎসা করাতে না পারায় মা-বাবার মনের কষ্ট উপলব্ধি করেছি। প্রাথমিকে পড়া অবস্থা থেকেই স্বপ্ন লালন করতে থাকি নিজের মধ্যে। ডাক্তার হতে হবে। অনেক বড় ডাক্তার। ডাক্তার হয়ে আমার বোন নুরানীর পায়ের চিকিৎসা করবো যেন সে স্বাভাবিক হয়ে হাঁটতে পারে। 

তিনি বলেন, শাহ সুলতান কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর  ডাক্তার মেহেদী হাসানের সঙ্গে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন করেছি। তারপর তার গাইড মেনে চলা শুরু করি। কৃষক পরিবারের সন্তান, তাই মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারেনি। ডাক্তার মেহেদী ভাই আমাকে গত কয়েকমাস পড়াশোনায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। মেহেদী ভাই আমাকে আমার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে যে অধ্যাবসায় করতে বলেছিলেন, আমি তা করেছি। আমি সফল হয়েছি। আমার স্বপ্ন লালনে এগিয়ে যেতে চাই।

গাংগইট গ্রামের সামিউলের প্রতিবেশীরা জানান, আমাদের গ্রামে অনেক বিত্তশালী রয়েছে। কিন্তু কোনো পরিবারে এমন মেধাবী ছেলে নেই। সামিউল আমাদের গ্রামের গর্ব। সাধারণ একজন কৃষকের সন্তান ডাক্তারি পড়াশোনা করবে এটা সত্যি বিস্ময়কর ব্যাপার। সামিউল যাতে পড়াশোনা করে বড় ডাক্তার হয় তার জন্য প্রতিবেশীরা দোয়া করেন।

ভর্তির বিষয় নিয়ে সামিউল জানান, আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। আমার পরিবারের সামর্থ্য নেই। তবুও চেষ্টা করব যাতে একজন ভালো ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারি। আল্লাহ আছেন, নিশ্চয় তিনি আমার সহায় হবেন।

ভর্তি নিয়ে আর্থিক দুশ্চিন্তায় এখন সামিউল ইসলাম ও তার পরিবার। সমাজের সচেতন মানুষরা এগিয়ে এলে হয়ত প্রত্যন্ত গ্রাম গাংগইটের সামিউল হয়ে উঠবে আগামী দিনের দেশসেরা মানবিক ডা. সামিউল ইসলাম।

এসপি