উম্মুল মাদারিস খ্যাত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার অন্তর্গত আলমপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবার নাম কাজি আব্দুল আজিজ বিন চাঁদ মিয়া বিন আসমত আলি জমিদার বিন কাজি মুহাম্মদ সালেহ। তিনি শায়খুল মাশায়েখ হজরত আল্লামা শাহ জমিরুদ্দীন রহ.-এর মুরিদ ছিলেন। তার ইন্তিকালের পর আল্লামা ইয়াহইয়ার বাবা আল্লামা হাফেজুর রহমান পীর সাহেব রহ.-এর হাতে মুরিদ হন।  তার মায়ের নাম আঞ্জুমান খাতুন। তিনি শায়খুল হাদীস হজরত আল্লামা সাঈদ আহমদ সন্দ্বীপী রহ.-এর মুরিদ ছিলেন।

নাম

আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়ার জন্মের পর তার বাবার অনুরোধে হজরত আল্লামা শাহ আব্দুল ওয়াহাব রহ. এবং হজরত আল্লামা হাফেজুর রহমান পীর সাহেব রহ.- এই দুই বুযূর্গ আলেম পরামর্শ করে ‘মুহাম্মদ ইয়াহইয়া’ নাম রাখেন।

প্রাথমিক শিক্ষা

১০ বছর বয়সে হাটহাজারী মাদরাসার ফোরকানিয়া মক্তব বিভাগের শিক্ষক কারী নুরুল হক আলমপুরী রহ.-এর কাছে মাদরাসা নেসাবের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনা অব্যাহত রেখে হাটহাজারী মাদরাসা থেকেই ১৯৭৩ খ্রীস্টাব্দে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন।

আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়ার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন- মুফতিয়ে আযম ফয়জুল্লাহ রহ., খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ রহ., শায়খুল আদব আল্লামা নজির আহমদ আনোয়ারী রহ., আল্লামা আবুল হাসান রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল আজীজ রহ., আল্লামা আব্দুল কাইয়ুম রহ., মুফতি আহমদুল্লাহ রহ., মাওলানা হামেদ রহ., আল্লামা নাদেরুজ্জাম রহ., মাওলানা ইব্রাহীম আলমপুরী রহ. ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ., আল্লামা আতিক জমিরী রহ., মাওলানা খালেদ হাবীবী রহ., মাওলানা সিদ্দিক আহমদ হাবীবী রাহ. হাফেজ মাওলানা ওমর হাবীবী রহ., মাওলানা ক্বারী ইয়াহইয়া রহ. প্রমুখ।

শিক্ষকতা

১৯৭৩ খ্রীস্টাব্দে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর হাটহাজারীর অন্তর্গত গড়দুয়ারা মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। গড়দুয়ারা মাদরাসায় ৯ বছর শিক্ষকতার পর ৩ বছর মাদার্শা মাদরাসা, এরপর হাজী ইউনুস রহ. প্রতিষ্ঠিত ঈছাপুর ফয়জিয়া তাজবিদুল কুরআন মাদরাসায় ৬ বছর শিক্ষকতা করেন। এখানে শিক্ষকতার সময়ে উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন মহাপরিচালক শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহ. এবং উস্তাযুল হাদীস আল্লামা কাসেম ফতেহপুরী রাহ.-এর আহ্বানে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতার পদে যোগদান করেন।

শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকে তার মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা দিয়ে উর্দুখানা থেকে দাওরায়ে হাদীস, তাফসির জামাত পর্যন্ত মানতেক, উলূমে হাদীস, উলূমে ফিক্বহ, উলূমে তাফসীর, উলূমে ফারায়েযসহ পর্যায়ক্রমে প্রায় সব কিতাবের অধ্যাপনা করে আসছেন। উলূমে তাফসীর, উলূমে হাদীস, উলূমে মানতেক, ও উলূমে ফারায়েযের উপর হযরতের দক্ষতা সর্বজন বিদিত।

হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন

দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক পদে মুফতিয়ে আযম আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামীর নিয়োগের সিদ্ধান্তের কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ইন্তিকালের পর মজলিসে শূরার একই বৈঠকে তাৎক্ষণিকভাবে (২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর) দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম (মহাপরিচালক) হিসেবে আল্লামা মুহাম্মাদ ইয়াহিয়া রহ.-কে নিয়োগ দান করা হয়। সেই থেকে ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পদে নিযুক্তির আগে থেকে আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ. দারুল উলূম হাটহাজারীর মুহাদ্দিসের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করে এসেছেন। তিনি কয়েক যুগ ধরে দারুল উলূম হাটহাজারীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মুখ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। 

হাটহাজারী মাদরাসায় তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জামিয়ার প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) প্রায়ই তার কাছ থেকেও মতামত নিতেন। জামিয়া পরিচালনায় প্রশাসনকি উদ্ভুত কোন সমস্যার মুখে পড়লে শায়খুল ইসলাম রহ. প্রায়ই তা সমাধার ভার আল্লামা ইয়াহইয়ার উপর অর্পণ করতেন।

এছাড়াও এর আগে কযেক যুগ ধরে তিনি দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার হিসাব বিভাগ পরিচালনা ও উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। পাশাপাশি আল্লামা ইয়াহইয়া বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য কওমি মাদরাসার শূরা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

তিনি ঈমান-আক্বিদাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর, কওমি মাদরাসার কেন্দ্রিয় বোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ (বেফাক)-এর সহসভাপতি, খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের সভাপতি, হাইয়াতুল উলইয়া বোর্ডের সদস্য এবং বাংলাদেশ নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ছিলেন।

বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বদানেও তার সুখ্যাতি ছিল সর্বজন বিদিত। তিনি যেমন সাধাসিধে, অমায়িক ও অনেক বিনয়ী এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তেমনি বহুবিধ যোগ্যতা ও গুণের অধিকারী ছিলেন।

এর আগে ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্ঠিত মজলিসে শূরার বৈঠকে আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়াকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট মজলিসে ইদারি (মাদরাসা পরিচালনা কমিটির)-এর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও বহু গুণের অধিকারী এই মহান ব্যক্তিত্ব ৩ জুন শনিবার রাজধানী ঢাকার বিশেষায়িত ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। তার ইন্তিকালের খবরে তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের আলেম, মাদরাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতার মাঝে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।