উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জনপদ রংপুর। সুপ্রাচীনকাল থেকে এই বিভাগীয় জেলা গৌরবময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাসের অধিকারী। এ জেলায় রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্যের অনেক নির্দশন। তেমনই একটি স্থাপত্য আকন্দপাড়ার এক কাতার মসজিদ। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুরে ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটির অবস্থান।

শ্যামপুর থেকে এক কিলেমিটারের কম দূরত্বে ১১ নম্বর গোপালপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের আকন্দপাড়ার নান্দিনার দিঘীর পাড় থেকে মাত্র ৩’শ গজের মধ্যেই পুরাতন এ ছোট মসজিদটি। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে মসজিদটির অবশিষ্ট অংশটুকু।

চারদিকে বাঁশের ঝাড়, তলাপাতা আর গাছগাছালিতে আড়াল হয়ে আছে ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি। বিরাট একটি বটবৃক্ষের ভারে নুয়ে পড়েছে মসজিদের অবকাঠামো। জঙ্গলের ভেতর ভুতুড়ে পরিবেশে থাকা মসজিদটি এখন পরিত্যক্ত। দীর্ঘদিনের অযত্ন, অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে মসজিদটি নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথাও নেই।

অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি।

ঝোঁপঝাঁড় এড়িয়ে একটু ভেতরে গেলে চোখে পড়বে— ইটের গাঁথুনি আর শৈল্পিক কারুকার্যে তৈরি মসজিদটি। সামান্য পরিমাণ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা— এই মসজিদের আয়তন নিয়ে বেশ কৌতূহল রয়েছে। এক গম্বুজ মসজিদবিশিষ্ট মসজিদটিকে অনেকে ‘এক কাতারি’ মসজিদ বলে ডেকে থাকেন। কারণ মসজিদটি এতই ছোট যে, এখানে ইমামসহ ৩-৪ জনের বেশি নামাজ পড়া সম্ভব না।

মসজিদটির উত্তর দক্ষিণে ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি ও পূর্ব পশ্চিমে ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। দেয়াল ১ ফুট ১১ ইঞ্চি চওড়া। আয়তনে এত ছোট মসজিদ দেশের আর কোথাও রয়েছে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে অনেক কৌতূহল।

কারুশিল্প খচিত মসজিদের গম্বুজসহ ভেঙে পড়েছে এর অবকাঠামো। মসজিদের গম্বুজ বেয়ে উঠেছে একটি বিরাট বটগাছ। এই বটবৃক্ষের ভরে খসে পড়েছে গাঁথুনি। ভেঙে পড়েছে দক্ষিণের দেয়ালটি। ছোট ছোট ইটের গাঁথুনিতে তৈরি প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন এই মসজিদে সময়ের পরিক্রমায় সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। অযত্ন-অবহেলা আর সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় বর্তমানে মসজিদটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে মসজিদের কোল ঘেঁষে দুইটি কবর রয়েছে।

মসজিদটি দেখতে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে পর্যটক ও দর্শনার্থীরা ছাড়াও স্থানীয় লোকজন আসেন। অনেকেই এ মসজিদ সংরক্ষণে লেখালেখিও করছেন। এ ব্যাপারে স্থানীয় গবেষক জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে জানান, মসজিদের কোথাও ফলক নেই। যা দেখে বোঝা যাবে এটি কত সনে নির্মিত। তবে মসজিদটি কারো মতে আড়াই শ’ বছর থেকে ৫০০ বছরের পুরাতন হবে। এখানকার পূর্বপুরুষদের মতে এই অঞ্চলে এত ছোট মসজিদ আর নেই। এর জমির পরিমাণ ও আকার-আয়তন খুবই কম।

তিনি আরও জানান, মসজিদের উত্তর দক্ষিণে ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি ও পূর্ব পশ্চিমে ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। দেয়াল ১ ফুট ১১ ইঞ্চি চওড়া। একটি প্রবেশ পথ ও মেহরাব রয়েছে। মসজিদটিতে ইমামসহ ৩-৪ জন নামাজ পড়তে পারতেন। মসজিদটির মিনার বা গম্বুজটি ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে মসজিদটিকে ঘিরে একটি বিরাট বটগাছ বেয়ে উঠেছে।

প্রাচীন এই নিদর্শনটি সংরক্ষণ ও সংস্কারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়েছে স্থানীয়দের। আকন্দপাড়ার বাসিন্দা কৃষক বাবর আলী বলেন, এত ছোট মসজিদও হয়, তাও মিনারসহ? তাদের বাপ-দাদার পূর্বপুরুষরা এই মসজিদের ইতিহাস ভালো জানতেন। আমরা শুনেছি এটি প্রায় ৩ থেকে ৪’শ বছর আগের মসজিদ। এই মসজিদটি সংস্কার করে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে এই মসজিদটিকে যুক্ত করা হলে এখানে আরো মানুষ আসবে।

একই এলাকার হাজী সেকেন্দার আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বয়স ষাটের কাছাকাছি। আমি তো জন্মের পর থেকে মসজিদটি ওই ভাবে পরিত্যক্ত দেখে আসছি। ওখানে নামাজ হয় না। আগে তো ওই জঙ্গলে সাপ পোকামাকড় ছিল। সেখানে কেউ আর যায় না। এখন গ্রামে একটি নতুন মসজিদ রয়েছে, সেই মসজিদেই নামাজ আদায় করা হয়।

স্থানীয় বৃদ্ধ মহসীন আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাপদাদারাও বলতে পারেনি এ মসজিদ কত সালে তৈরি। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁপ জঙ্গলের ভিতর ওই মসজিদটি দেখে এসেছি। এখন তো আগের মতো জঙ্গল নেই, পোকাকামড়ের ভয় নেই। মসজিদটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সরকারি ভাবে যদি কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়, তাহলে হয়তো ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এটার স্মৃতিচিন্থ থাকবে।

পুরাতন এ মসজিদ সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে রংপুরের ইতিহাস গবেষক ও লেখক রানা মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্ভবত এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট মসজিদ। এক গম্বুজ ও এক কাতারের মসজিদ। এখন এটার আমরা ধ্বংসাবশেষটা দেখছি। এর দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ে গেছে। বটগাছ ও পাকড়গাছ মসজিদের চারিদিকে উঠে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো রক্ষণাবেক্ষণ বা সংরক্ষণ করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ছোট এই মসজিদটির আয়তন দৈর্ঘ্য ৯ ফিট ও প্রস্ত ৫ ফিট। এখানে একজন ইমামসহ সর্বোচ্চ তিন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। এখন ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকে মুঘল আমলের প্রাথমিক যে স্থাপনাগুলোর সাথে এটার কিছুটা বাহ্যিক মিল রয়েছে। এর গম্বুজ ও নকশা দেখে অনুমান করা যায় অনেক প্রাচীন। এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে এটি নির্মিত হতে পারে বলেও ধারণা করা হয়। কারণ মুসল্লি বেশি হলে মসজিদ বড় হয়, কিন্তু ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে তেমন মুসল্লি না থাকায় হয়তো মসজিদটি ছোট করা হয়েছে। তবে এই মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট দলিল নেই। বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও স্থানীয়দের ভাষ্য মতে মসজিদটি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে নির্মিত হবে। সেই হিসেবে মসজিদটির বয়স সাড়ে ৪০০ বছর হবে।  

রংপুর বিভাগীয় প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম আহবায়ক জাকির আহমেদ বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের প্রাচীন স্থাপত্য, নিদর্শন ও ঐতিহাসিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং সংস্কারের জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন কাজ হয়নি। রংপুরে এমন অনেক স্থাপত্য ও প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু এসবের সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ উদাসীন।
 
এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর রংপুর ও রাজশাহী বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক মোছা. নাহিদ সুলতানা ঢাকা পোস্টকে জানান, মসজিদটি গত বছর পরিদর্শন করা হয়। প্রাচীন ওই মসজিদ সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে জানানো হয়েছে। তবে মসজিদের গম্বুজের ওপর দিয়ে উঠে যাওয়া বটগাছটি কেটে ফেলা সম্ভব নয়। গাছ কাটতে গেলে মসজিদের বাকি ধ্বংসাশেষটুকু থাকবে না।