প্রতীকী ছবি

রমজানে মারা গেলে কবরের আজাব হয় না— কথাটি বেশ প্রসিদ্ধ। প্রায় সবার নিকটই পরিচিত। এতো বেশি প্রসিদ্ধ যে, এবিষয়ে কোনো সংশয় থাকতে পারে— এটা কারো ভাবনাতেই আসে না। বরং সবাই এটাকে অকাট্য দলিলের প্রমাণিত বিষয় হিসেবেই জানেন। কিন্তু বাস্তবেই কি তাই? বিষয়টি একটি পর্যালোচনার দাবী রাখে।

রমজানে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আজাব মাফ হয়, এসম্পর্কে হাদিসের প্রসিদ্ধ কোনো কিতাবে একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না। ফিকহ-ফতওয়ার কিতাবসহ যেসকল কিতাবে এবিষয়ক আলোচনা রয়েছে সেগুলোর কোনোটিতেই এসংক্রান্ত সুস্পষ্ট একটি রেওয়ায়েতও পেশ করা হয়নি। অবশ্য কেউ কেউ নিম্নোক্ত হাদিসটির মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। 

হাদিসটি হচ্ছে-

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজন প্রবেশ করে— জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৭৭; মুসলিম, হাদিস : ১০৭৯)

একটু খেয়াল করে দেখুন তো, উপর্যুক্ত হাদিসের কোথাও কি বলা হয়েছে, রমজানে মৃত্যুবরণ করলে কবরের আজাব মাফ হয়ে যাবে। বরং মুহাদ্দিসিনে কেরাম এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কয়েকটি উদ্দেশ্য রয়েছে-

ক. 
বাক্যটি হয়তো হাকিকি (বাস্তব) অর্থেই ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের জন্য রমযান মাস প্রবেশের আলামত এবং এর পবিত্রতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আলামত হিসেবে, রমজানে জান্নাতের দরজা খুলে দেন আর জাহান্নামে দরজা বন্ধ করে দেন।

খ. 
আবার কথাটি রূপক অর্থেও হতে পারে। রূপক অর্থে হলে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার অর্থ হবে, বেশি বেশি সওয়াব লিখে দেওয়া আর জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ হবে বেশি বেশি ক্ষমা করা। এই অর্থটি সুদৃঢ় হয়ে যায় অন্য বর্ণনার মাধ্যমে, যেই বর্ণনায় এসেছে, فتحت أبواب الرحمة (রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়)

গ. 

অথবা রূপক অর্থ এও হতে পারে যে- এই মাসে আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য যেসকল নেক কাজের তৌফিক দেন, যেমন রোজা, কিয়ামুল লাইল ও অন্যান্য কেন কাজ; পাশাপাশি আল্লাহকর্তৃক নিষিদ্ধ যে সব কাজ থেকে বিরত থাকার তৌফিক দেন, এগুলোই জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া এবং জাহান্নামের দরজা বন্দ করে দেওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য। কেননা এই নেক কাজগুলো করা আর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকাই তো জান্নাতে প্রবেশ করা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ। (ইকমালুল মুলিম, ফাতহুল বারি : ৪/৫)

বোঝা গেল হাদিসের হাকিকি অর্থ গ্রহণ করা হোক কিংবা রুপক অর্থ গ্রহণ করা হোক কবরের আজাব মাফ হওয়ার সাথে এই হাদিসের কোনো সম্পর্ক নেই।

কেউ কেউ রমজানে মৃত্যুর ফজলত প্রমাণের জন্য আনাস (রা.)-এর একটি বক্তব্যকে দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন। কথাটি হচ্ছে- ‘রমজান মাসে মৃত ব্যক্তি থেকে কবরের আজাব উঠিয়ে নেওয়া হয়।’

কিন্তু এই কথার ভিত্তি কী? হাদিসের কোনো কিতাবে কি এমন কথা পাওয়া যায়? না, এটি এমন একটি কথা— হাসিদের প্রসিদ্ধ কোনো কিতাবে যার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।  যতটুকু পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে, ইমাম রজব হাম্বলি তার কিতাব ‘আহলুল কুবুর ওয়া আহওয়ালু আহলিহা ইলান নুশুর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-
روى باسناد ضعيف عن انس بن مالك ان عذاب القبر يرفع عن الموتي في شهر رمضان

‘আনাস (রা.) থেকে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রমজন মাসে মৃত ব্যক্তি থেকে কবরের আজব উঠিয়ে নেওয়া হয়।’ (‘আহলুল কুবুর ওয়া আহওয়ালু আহলিহা ইলান নুশুর, পৃষ্ঠা : ১০৫)

ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) উপরিউক্ত রেওয়ায়েতের কোনো সনদ উল্লেখ করেননি; আবার হাদিসটি কোন কিতাবের তাও উল্লেখ করেননি; অথচ এর পরক্ষণেই তিনি জুমার দিনে মৃত্যু-সংক্রান্ত হাদিসটি মুসনাদে আহমদ এবং সুনানে তিরমিজির উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন। এটি যদি হাদিসের কোনো কিতাবে থাকতো তাহলে অবশ্যই এর সূত্র উল্লেখ করতেন।

তাছাড়া হাদিসটি যে সহিহ নয়, তা তো ইবনে রজব (রহ.) নিজেই উল্লেখ করে দিয়েছেন। কেউ হয়তো বলতে পারেন, হাদিস দুর্বল হলে কী সমস্যা, দুর্বল হাদিস তো আমলের ফজিলতের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। না, এটি আকিদা; এটি ফাজায়েলের বিষয় নয়। আর আকিদার ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তাছাড়া হাদিসটির কোনো সনদই তো ইবনে রজব (রহ.) উল্লেখ করেননি। যদি সনদ উল্লেখ করতেন, তাহলে আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারতাম, সেটি কোন পর্যায়ের দুর্বল। সাধারণ দুর্বল, নাকি অতি দুর্বল নাকি জাল। জাল হলে তো কথাই নেই; যদি জাল না হয় কিন্তু অতি দুর্বল হয়ে থাকে— তাহলেও তো ফাযায়েলের ক্ষেত্রেই এমন হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়; আকিদা তো দূরের কথা।

হাদিসের প্রসিদ্ধ কোনো কিতাবে যদি রেওয়ায়েতটি পাওয়া যেত, তাহলে ফিকহ-ফতওয়ার কিতাবাদিসহ যেসব কিতাবে রমজানে মৃত্যুর আলোচিত ফজিলতের কথা উল্লেখ হয়েছে, ওই সব কিতাবে উপরিউক্ত হাদিসটি সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হতো। কিন্তু কেউই এমন কোনো বর্ণনাকে দলিল হিসেবে পেশ করেননি; বরং তারা প্রথম হাদিস অর্থাৎ রমজানে জান্নাতের দরজা রহমতের দরজা খুলে দেওয়া, আল্লাহর পক্ষ থেকে এ মাসে রহমত এবং বরকত এবং মাগফিরাতের ঢল নামা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় শুধুমাত্র আশা ব্যক্ত করেছেন যে, রমজানে মৃত্যুবরণ করলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা কবরের আজাব মাফ করে দেবেন। কিন্তু আকিদার বিষয় তো ধারণা-নির্ভর নয়; ধারণার ভিত্তিতে আকিদার কোনো বিষয় প্রমাণিত হয় না।

আকিদা শাস্ত্রের বিশিষ্ট ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে সালেম ইবনে সুলায়মান আস সাফারিনি (রহ.) ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.)-এর পূর্বোক্ত কথা অর্থাৎ রমজানে কবরের আজাব মাফ হয়ে যায় উপরিউক্ত বক্তব্য এবং কালাম শাস্ত্রের ইমাম নাসাফি (রহ.)-এর এ জাতীয় একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন-
‘এটা তো ধারণামাত্র, যার স্বপক্ষে কোনো দলিল নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর হাদিসের সামান্য স্বাদও আস্বাদন করেছে, সে এধরনের হাদিসের দিকে কর্ণপাত করবে না। কেননা ইবনে রজব (রহ.) তো দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, কবরের আজাব রমজান মাসব্যাপী উঠিয়ে নেওয়া হয়; অথচ জানা কথা হাদিসটি জয়িফ। এই ধরনের বড় বিষয়ে (আকিদার বিষয়ে) জয়িফ হাদিসের ওপর নির্ভর করা হয় না। (আল-বুহুরুজ জাখিরাহ : ১/২৪৬)

কেউ কেউ হযরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হাদিস-
من وافق موته عند انقضاء رمضان دخل الجنة 
 ‘রমজান সমাপ্তির সময়ে যার মৃত্যু সংঘটিত হয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (আবু নুআইম আসফাহানি, হিলইয়াতুল আওলিয়া : ৫/২৩)

এই হাদিসের মাধ্যমে বিষয়টি প্রমাণিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা সঠিক নয়। কারণ: ক. হাদিসের একজন বর্ণনা হচ্ছেন, নাসর ইবনে হাম্মাদ। তিনি নিতান্তই দুর্বল। এমনকি ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন (রহ.) তাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। আর আবুল ফাতাহ আজদি (রহ.) বলেন, সে একটি হাদিস জাল করেছে।

খ.
হাদিসটি যদি প্রমাণিতও হতো তবু্ও তো সেটি দলিল হিসেবে উল্লেখ করার উপযোক্ত হতো না। কারণ জান্নাতে প্রবেশ করা আর কবরের আজাব মাফ হয়ে যাওয়া দুইটি এক বিষয় নয়। কত লোকই তো এমন হবে— যারা জান্নাতে প্রবেশে করবে, কিন্তু কিছু অপরাধের কারণে তাদের কবরে আজাব হবে।

এবার কয়েকটি কথা বলতে চাই—

এক. কবরের আজাব সত্য। কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। এই আজাব থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত ঈমান। দ্বিতীয় শর্ত ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবনযাপন, বিশেষত যেসব গুনাহর কারণে কবরে আজাবের কথা বর্ণিত হয়েছে, তা থেকে সর্বোতভাবে বেঁচে থাকা এবং যেসব আমলের মাধ্যমে কবরের আজাব থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি বর্ণিত হয়েছে, সেসব আমল গুরুত্বসহকারে করা। আর কবর ও আখিরাতকে সর্বোচ্চ সুন্দর বানানোর চেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত থাকা উচিত।

দুই.
আল্লাহ তাআলা পরকালে নাজাত এবং শাস্তি থেকে মুক্তির বিষয়টি আমলের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। বিশেষ কোনো দিনে বা রাতে মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত করেননি। তাছাড়া এটি একটি গায়রে এখতিয়ারি ফে‘ল। সুতরাং এর সঙ্গে আজাবে কবর মাফ হওয়ার বিষয়টি অযৌক্তিক।

তিন.

আল্লাহর রাসুলের কত সাহাবি যাদের জান্নাতি হওয়ার ব্যাপারে আমরা আশা রাখি তারাও সেই আজাবে কবর থেকে মুক্তি পাননি। (এ সম্পর্কে প্রশ্রাব থেকে সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণে আজাব হওয়ার হাদিসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) অথচ কত খারাপ লোগ আছে, যে সারাটি জীবন সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি এবং নেশার মধ্যে কাটিয়েছে, এমন লোকের মৃত্যুও রমজান মাসে হয়।

যে ব্যক্তি সারাটি জীবন হারামের উপর কাটিয়েছে; কিন্তু শুধু একটি গায়রে এখতিয়ারি (বা অনিচ্ছাকৃত) আমলের করণে আজাবে কবর থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, যে আজাব থেকে আল্লাহর রাসুলের সাহাবিও মুক্তি পাননি; বিষয়টি একটু অযৌক্তিক হয়ে গেল না।

চার. 
গুনাহগারের জন্য কবরের আজাবের বিষয়টি কোরআন হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এর বিপরিত কারো জন্য যদি কবর আজাব মাফ হওয়ার দাবি করতে হয়, তাহলে এর স্বপক্ষে অকাট্য দলিল থাকতে হবে। অথচ উপরে আমরা আলোচনা করেছি যে, এসম্পর্কে কোনো ধরনের নির্ভযোগ্য দলিলই পাওয়া যায়নি।

এসম্পর্কে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকিহ মোল্লা আলী কারি (রহ.)-এর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ফিকহুল আকবারের ব্যাখ্যা গ্রন্থে আবু মুয়িনের রমজান এবং শুক্রবারে কবরের আজাব মাফ সংক্রান্ত আলোচনাটি উল্লেখ করে বলেন- এটা সুস্পষ্ট বিষয় যে আকিদার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য হলো, ইয়াকিনি তথা সুনিশ্চিত দলিল। ‘হাদিসে আহাদ’ (যে হাদিসটি মুতাওয়াতির পর্যায় পৌঁছায়নি) যদি প্রমাণিত হয় তবে তা জন্নি তথা সুনিশ্চিত দলিল নয়। তবে হাদিসটি যদি একাধিক সনদের কারনে মুতাওতিরে মানবি (এমন দলিল যা এত সুত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যৌক্তির নিরিখে এটাকে মিথ্যা বলা সম্ভব না হয়, তখন সেটা কাতয়ি (সুদৃঢ় দলিল) হয়ে যাবে। (মিনাহুর রওদিল আজহার ফি শরহে ফিকহুল আকবার : ২৯৫-২৯৬)

পাঁচ.
যদি মেনে নেওয়া হয় যে, রমজানে মৃত্যু বরণ করলে আজাবে কবর মাফ হয় তাহলে একথা তো দুর্বল-সবল কোনো রেওয়ায়েত দ্বারাই প্রমাণ হয় না যে, রমজানে মৃত্যু বরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত আজাব মাফ হয়ে যায়। অথচ এমন কথাও লোকমুখে প্রসিদ্ধ।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে রমজান মাসে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আজাব মাফ হয়ে যায়, এটি ভিত্তিহীন একটি কথা। সুতরাং এমন কথা প্রচার না করাই কাম্য।