দৃষ্টিনন্দন আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ। ছবি : ঢাকা পোস্ট

অপরূপ সৌন্দর্যের নজরকাড়া নিদর্শন আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ। সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে  সদ্য নির্মিত মসজিদটি দেশজুড়ে বহু মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে সিরাজগঞ্জবাসীর মনোযোগ আকৃষ্ট করেছে। অনেকেই ধারণা করছেন— নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এটি দেশের অন্যতম সেরা মসজিদ হবে।

গত ০২ এপ্রিল (শুক্রবার) জুমার নামাজের মাধ্যমে মসজিদটি উদ্বোধন করেন কর্তৃপক্ষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি ও দেশ বরেণ্য আলেম-ওলামাদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। 

সিরাজগঞ্জ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বেলকুচি পৌরসভা এলাকার ৭ নং ওয়ার্ডের মুকন্দগাঁতী মহল্লার সিরাজগঞ্জ-এনায়েতপুর সড়কের পশ্চিম পাশে পৌরসভা কার্যালয়ের পাশেই আড়াই বিঘা জমির ওপর ৩১ হাজার স্কয়ার ফিটে নির্মিত হয়েছে আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদটি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুকুন্দগাঁতী এলাকার বাসিন্দা রহমত গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রয়াত শিল্পপতি মোহাম্মদ আলী সরকারের নির্মিত বাহেলা খাতুন চক্ষু হাসপাতাল এলাকার দুস্থ রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বিনামূল্যে সেবা দিয়ে আসছে। ২০১২ সালে তিনি আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদটির ভিত্তিপ্রর স্থাপন করেন। নিজস্ব অর্থায়নে ছেলে আমানুল্লাহ সরকার ও মা বাহেলা খাতুনের নামে ‘আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদ’ কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। শুরু থেকে প্রতিদিন অর্ধ-শতাধিক শ্রমিক  মসজিদটি নির্মাণে কাজ করেন। আর নির্মাণকাজ শেষ হতে সর্বমোট নয় বছর সময় লেগেছে। কিন্তু মসজিদটি নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই ২০২০ সালের ০২ আগস্ট মারা যান শিল্পপতি মোহাম্মদ আলী সরকার। এরপর তার ছেলে আমান উল্লাহ সরকার মসজিদটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নয়নাভিরাম দ্বিতল এই মসজিদটির ওপরে বিশাল আকৃতির একটি গম্বুজের পাশাপাশি ছোট-ছোট আরও আটটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির দুইপাশে রয়েছে ১১ তলা সমতুল্য (১১০ ফিট) উচ্চতার মিনার। মসজিদের ভেতরে মার্বেল পাথর ও গ্রানাইড পাথর দিয়ে মোড়ানো দৃষ্টিনন্দন নয়নাভিরাম কারুকাজ নজর কেড়ে নেয় দর্শনার্থী ও মুসল্লিদের। মসজিদের চারপাশে রয়েছে সাদা রঙের পিলার, সুউচ্চ জানালা ও সাদাটে টাইলস। চত্বরে পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে সবুজ ঘাস। সবকিছু মিলিয়ে যেন অনন্য সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে।

আরও পড়ুন : পাহাড়ের চূড়ায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

রাত এলেই আলোর ঝলকানিতে অপরূপ অবয়বে শোভিত হয় মসজিদটি। চতুর্দিকে রং-বেরঙের আলোকসজ্জা দূরের দর্শনার্থীকেও আকৃষ্ট করে। মসজিদের ভেতেরও রয়েছে একাধিক ঝাঁড়বাতির আলো। বেশ দূর থেকেই মসজিদের গম্বুজ ও নির্মাণাধীন মিনার দু্ইটি দৃষ্টি কাড়ে। রাতের বেলা এক অন্যরকম আবহের সৃষ্টি হয়। আর পরিবেশ ও আঙিনা— সব মিলিয়ে বেশ শান্ত ও মনোরম। 

আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদের স্থাপত্যশৈলী যে কোনো দর্শককে মুগ্ধ করবে। বিশেষ করে মসজিদের সম্মুখের উচ্চ দুইটি সিঁড়ি এবং ব্যতিক্রমী প্রবেশপথ ও প্রধান ফটক যে কারও দৃষ্টি কাড়ে।

মসজিদের পাশেই ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের থাকার জন্য কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়েছে। রয়েছে পাঠাগার ও শৌচাগার। সেইসঙ্গে মসজিদের প্রবেশ পথের দুই সিঁড়ির পাশে কাঁচে ঘেরা অটো ফিল্টার করা পানি দিয়ে অজু করার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া ইতালি ও ইন্ডিয়া থেকে আনা উন্নতমানের মার্বেল পাথরসহ কাঠের কারুকাজে মসজিদের বিভিন্ন স্থানকে আকর্ষণীয় করতে নান্দনিক নকশার কাজের যেন খামতি নেই কোথাও। মসজিদটিতে প্রায় পাঁচ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।

সিরাজগঞ্জ শহর থেকে আসা দর্শনার্থী টি.এম.এ হাসান জোহরের নামাজ শেষ করে বের হয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেলকিচিতে একটা কাজে এসেছিলাম। এর মধ্যে নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় এখানে এসে নামাজ আদায় করলাম। তিনি বলেন, এতো সুন্দর একটি মসজিদ করা হয়েছে— যা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। ভেতরে গেলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। ইচ্ছে করলো— আসর ও মাগরিবের নামাজটাও এখানেই পড়ে যাই। আমি মনে করি, সবারই সময়-সুযোগ করে অন্তত একবার হলেও এসে বেড়িয়ে যাওয়া উচিৎ। 

আল-আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদের ইমাম মো. আরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মসজিদটির শুরু থেকেই দায়িত্বে আছি। মসজিদের সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ইসলাম সুন্দর ও পবিত্রতা পছন্দ করেন। একটা হাদিস আছে, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার চেহেরা যেমন সুন্দর করেছো— আমার চরিত্রও তেমনি সুন্দর করো। এখানে নামাজ পড়তে এসে মুসল্লিরা তৃপ্তি পান, নামাজে পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন। এখানে এক সঙ্গে পাঁচ হাজার মানুষের নামাজের ব্যাবস্থা আছে। উদ্বোধনের দিন এখানে ভেতরে-বাইরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেছেন।

আরও পড়ুন : সেন্ট পিটার্সবার্গ নীল মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য

আল আমান বাহেলা খাতুন জামে মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আড়াই বিঘা জমির ওপর মসজিদটি নির্মান হয়েছে। তিনি বলেন অনেক মিডিয়াই ৩০ থেকে ৪০কোটি পর্যন্ত অনেক কথা লিখছেন। কিন্তু আসলে আমাদের প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। যেটুকু কাজ বাকি আছে— তা এর মধ্যেই হয়ে যাবে।

তিনি মসজিদটি তৈরির প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে ঢাকা পোস্টকে জানান, সখের বশেই ২০১২ সালে একদিন এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মোহাম্মদ আলী সরকার তার সহধর্মিণী নিয়ে এখান দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। তখন মসজিদের জায়গাটা ছিল বনের বাগান। হঠাৎই তার সহধর্মিণী তাকে বললেন আমার কিছু টাকা আছে তুমি কোনো কাজে লাগাও। তখন চেয়ারম্যান স্যার বললেন- তাহলে এখানে একটি মসজিদ করি। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে আমার সামনেই কথা হলো। পরবর্তীতে এরই বাস্তবায়নে ২০১৪ সালে মসজিদটির কাজ শুরু করা হয়। এখানে তার সহধর্মিণী সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করলেও পাশাপাশি তিনি ও তার সন্তানরাও সবাই এখানে অর্থায়ন করেছেন। 

আলমগীর হোসেন আরও বলেন,  বর্তমান আমাদের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক আল আমান স্যারের ইচ্ছা আছে এখানে ৪ জন খতিব নিয়োগ হবে যারা মাসে একবার করে নামাজ পড়াবে। এছাড়াও এখন দুইজন ইমামসহ শুধু মসজিদে ১০ জন কর্মরত আছেন।