প্রতীকী ছবি

একুশ বছরের যুবক নাগিদ মুরিত। শ্রীলঙ্কার এক হিন্দু পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পারিবারিক ঐতিহ্য ধারণ করে ধর্মীয় কাজকর্মে আসক্ত হয়ে পড়ে সেই বাল্যকাল থেকে। কৈশোরে পা দেওয়ার পর ধর্মীয় তৎপরতায় আরও সক্রিয় হয়ে উঠে নাগিদ। ফলশ্রুতিতে নিজ এলকার মন্দিরের যুব সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হয়। ধর্মের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তার হৃদয় ভরপুর ছিল। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সন্তুষ্টি অর্জনে দিনরাত ধর্মীয় কাজে পড়ে থাকত।

কিন্তু একুশ বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। কাতারের একটি কনসট্রাকশন গ্রুপে চাকুরী হয় তার। রোড কনসট্রাকশনের কাজ পরিদর্শন ছিল দায়িত্ব। তার সহকর্মী ছিল এক আরব মুসলিম। 

একসময় সেই সহকর্মীর দাওয়াতে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ নাগিদ মুরিত। কালিমার পতাকাতলে আসার পর নতুন নাম নির্বাচন করে মুহাম্মদ সাজিদ।

আসুন, আগের নাগিদ মুরিত ও আজকের মুহাম্মদ সাজিদের মুখে শোনা হোক— তার ইসলাম গ্রহণের ঈমানজাগানিয়া বর্ণনা।

একটি পৌত্তলিক সমাজে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। যেখানে গাছ-পাথরের উপসনা করত সবাই। প্রত্যেকেই নিজের পছন্দসই প্রভু নির্বাচন করত উপসনার জন্য। উপাস্য-প্রভুকে নিজের দেওয়া নির্দিষ্ট নামে আহ্বান করত।

আমিও একটি নির্দিষ্ট প্রভুর উপসনা করতাম। নাম রেখেছিলাম কারমান। কারমান অর্থ হলো- রক্ষাকারী। আমার সমাজে হাজার হাজার প্রভুর উপসনা হতো। যে যতো বেশি প্রতিমা পূজা করত— তাকে ততো বেশি সম্মানের চোখে দেখতাম। সম্মান দেখাতে গিয়ে একসময় গাছ ও পাথরের মতো প্রভু ভেবে তারও উপসনা করত অন্যরা। কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিল, যে নিয়মিত পূজা করলে— প্রভু সেটাতে প্রতিস্থাপিত হয়। ফলে আমরা তার উপসনা করতাম। তার পা ধূয়ে দিতাম। মুখে চুমা দিতাম। আর তার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিতাম।

আমার পিতামাতা থেকে আমি প্রতিমা-ভক্তি পেয়েছিলাম। প্রতি সপ্তাহে সোম ও মঙ্গলবার আমি তাদের সঙ্গে মন্দিরে যেতাম। উপসনা করতাম, আশীর্বাদ নিতাম ও তাদের কাছে সবার মঙ্গল কামনা করতাম।

কাতার আসার সময় আমার ‘প্রভু’ কারমানকেও সঙ্গে আনলাম। সর্বদা সঙ্গে রাখতাম, যেকোনো কাজের আগে আশীর্বাদ নিতাম। গাড়িতে আরোহনের আগে সিজদা করতাম। আমার আরবি-বন্ধু এসব দেখে আমাকে বুঝিয়ে বলতো— এসব বানানো প্রভু কারো লাভ ও ক্ষতি করতে পারে না। আমি চাইলে তার ক্ষতি করতে পারি; কিন্তু তোমার প্রভু এই ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারবেনা।

তার কথায় আমি প্রথম ধাক্কা খেলাম। বিষয়টি আগে কখনো এভাবে চিন্তা করিনি। ভাবলাম- হ্যাঁ, এসব প্রভু তো নিজের ক্ষতি প্রতিরোধ করতে পারেনা। তারপরও এটিকে দুশ্চিন্তা মনে করে— উড়িয়ে দিয়ে আমার প্রভুর উপসনার নিমগ্ন থাকলাম।

এরপর আরবি-বন্ধু আমাকে ধর্ম সম্পর্কে আরও কিছু প্রশ্ন করল। কিন্তু আমি কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিনি। এক পর্যায়ে সে আমাকে বললো, আচ্ছা! বলো তো, তোমার ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে কি লিখিত রয়েছে— এই প্রতিমাই তোমার প্রভু? উত্তরে বললাম, তেমন কিছু আছে বলে আমার জানা নাই। তখন সে বলল, আমরা এমন প্রভুর ইবাদত করি, যার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে— আমাদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআনে। তিনি অদৃশ্য— তবে  আমাদের সবকিছু দেখেন। তাহার আদেশ অমান্য করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে ইত্যাদি।

তার কথায় আমার ভাবান্তর হলো। আমার ধর্মীয় চিন্তায় এভাবে দ্বিতীয় ধাক্কা খেলাম। এরপর আমি  মুসলমানদের নামাজ আদায় পদ্ধতি পর্যবেক্ষন করলাম। ভোর চারটায় ফজর সালাত আদায় করতে জাগ্রত হওয়ার দৃশ্য দেখলাম। একাগ্রতার সঙ্গে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের দৃশ্যও দেখলাম।

অদৃশ্য প্রভুর আদেশ পালনার্থে, পুণ্যের আশায় ও শাস্তির ভয়ে এতো সুশৃঙ্খল ও ভক্তিময় উসপনা— আমি আগে কখনো দেখিনি। আমি নিজেই মন্দিরের যুব সংঘের সভাপতি ছিলাম। আমাদের উপসনায় তেমন কোন নিয়ম-নীতি ছিলোনা। মন্দিরে উপস্থিত ভক্তবৃন্দের মধ্যেও এমন ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখিনি। এভাবে ইসলামের সত্যতা আমার কাছে দৃশ্যমান হয়।

আরও দেখলাম, বিপদ-আপদে মুসলমানরা সবর করে। বিপদকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করে ধৈর্য ধারণ করে। তারা সর্বাবস্থায় তাদের প্রভুর শোকরিয়া আদায় করে। এতেই ইসলামের প্রতি পরিপূর্ণ আকৃষ্ট ও মুগ্ধ হয়ে যায়।

এভাবে ইসলামের সৌন্দর্য ও সমতার রূপময় দৃশ্যসমূহ দেখে আমি বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম। ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম। যে আরব বন্ধুর দাওয়াতে আমি ইসলাম জানলাম তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। দিনটি ছিল জুমাবার। সে আমার বাসায় এসে আমাকে সঙ্গে করে মসজিদে উপস্থিত হল। জুমার নামাজের পর ইমাম সাহেবের সঙ্গে কালিমা উচ্চারণ করে ইসলামে সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলাম। আলহামদুল্লিাহ।

ইসলাম গ্রহণের পর পূর্বের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম নির্বাচন করলাম— মুহাম্মদ সাজিদ। ইসলাম গ্রহণের খবর জেনে আমার পরিবার ভীষণ রাগ দেখাল। আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের নানা চাপ অব্যাহত রাখে। কিন্তু আমি ইসলামে অবিচল থাকি। আমার বিশ্বাস  কিয়ামত দিবসে মহান প্রভুর সামনে হিসাবের সময় তারা আমার কোনো উপকারে আসবে না।

ইসলাম সম্পর্কে না জানার কারণে তাদের এই অবস্থা। তারা একটি পৌত্তলিক সমাজে বসবাস করছে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের নূন্যতম ধারনাও নাই। তাই আমি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করছি— তাদের ইসলাম বোঝানোর জন্য। ইসলামের সৌন্দর্যমণ্ডিত ইবাদত-পদ্ধতি ও সাম্যবাদী সামাজিক নিয়ম-পদ্ধিতি তাদের সামনে তোলে ধরতে পারলে— তারা ইসলাম মেনে নেবে। এটাই আমার বিশ্বাস। মহান প্রভু এই মিশনে আমাকে সফল করুক। আমিন।

তথ্যসূত্র: কাতারের চ্যারিটেবল সংস্থা ঈদ আল-খাইরিয়্যাহ এর ওয়েবপেজ থেকে সংগৃহিত ও অদূদিত।