ইরানে ইসলামের আগমন যেভাবে
ইতিহাসের পাতায় কিছু ঘটনা এমনভাবে জায়গা করে নেয়, যা শুধু একটি দেশের মানচিত্র নয়, বরং তার মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ভাবনার ধারা বদলে দেয়। ইরানে ইসলামের আগমন তেমনই এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইরানে মুসলমানদের বিজয় শুধু কোনো যুদ্ধের জয় ছিল না, ছিল এক আদর্শের বিজয়, যা দীর্ঘদিনের অন্যায়, বৈষম্য আর দুঃশাসনের অন্ধকার ছিন্ন করে ন্যায় ও সত্যের আলোকে ছড়িয়ে দিয়েছিল সর্বত্র।
সাসানীয় সাম্রাজ্য : পতনের পূর্বসন্ধ্যায়
বিজ্ঞাপন
ইসলাম আগমনের পূর্বে ইরান ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এক বিশাল ও সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য, যার শাসকরা নিজেদেরকে ঈশ্বরের ছায়া মনে করত। ধর্ম হিসেবে মাজদেয়ান ধর্ম পালন করতো । অহুর মাযদা নামে এক ঈশ্বরের উপাসনা করায় এই নাম ব্যবহৃত হয়। (আহুরা শব্দের শাব্দিক অর্থ প্রভু আর মাজদা অর্থ প্রজ্ঞা। ঋগ্বেদের ২:১:৬ সুক্তে তাকে অসুর মহৎ বলে উল্লেখ করা)
এই মতবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে ধর্মীয় নেতাদের দুর্নীতি, শোষণ ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষ ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছিল। সমাজ ছিল কঠোর শ্রেণিবিন্যাসে বিভক্ত। দরিদ্ররা ছিল নির্যাতিত, ধনীরা ছিল সর্বেসর্বা, আর রাজনীতির ছদ্মাবরণে চলছিল সীমাহীন দুর্নীতি ও অবিচার। এমন এক সময়ে ইসলামের মুক্তির বার্তা এলো ন্যায়ের প্রতীক হয়ে।
বিজ্ঞাপন
ইসলামী বিজয়ের প্রথম ধারা : আলোড়নের সূচনা
খলিফা আবু বকর (রা.) এর শাসনামলে সাহাবি মুসান্না ইবনে হারিসা (রাযি.) ইরানের সীমান্তবর্তী সাওয়াদ অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন। তার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা জয় করে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে। এই বিজয় ছিল সাম্রাজ্যবাদী দম্ভের প্রথম ফাটল এক নতুন ইতিহাসের ভূমিকা।
এরপর খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রায.)-এর সময় বিজয়ধারা পেল পূর্ণ গতি। মুসলমানরা যুদ্ধ করেছিল নিছক ক্ষমতার জন্য নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের প্রসার ও শোষিতদের মুক্তির লক্ষ্যে।
আরও পড়ুন
কাদিসিয়া: ইতিহাসের মোড় ঘোরানো যুদ্ধ
১৪ হিজরিতে সাহাবি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) -এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পারস্যের বুকে ঐতিহাসিক কাদিসিয়া যুদ্ধের পদক্ষেপ নেয়। পারস্যের কিংবদন্তি সেনাপতি রুস্তুম নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীকে, যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৮ হাজার।
মহররম মাসের এক সোমবার, প্রবল ঝড়ে পারস্য বাহিনীর তাঁবুগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এমনকি রুস্তুমের বসার আসনও উড়ে যায়। পালাতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে নিহত হন। পারস্য বাহিনী বিশৃঙ্খলায় পড়ে যায়। এই যুদ্ধে পারস্যের প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য নিহত হয় এবং মুসলিম বাহিনী পায় এক ঐতিহাসিক বিজয়।
মুসলমানরা এরপর পারস্যের রাজপ্রাসাদ ইওয়ান এর শহর মাদায়েন দখল করে নেয় এবং সেখানকার বিপুল গনীমত সংগ্রহ করে। এক-পঞ্চমাংশ খলিফা ওমরের (রা.) কাছে প্রেরণ করা হয়। এটি ছিল ইসলামের সামরিক ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। (সূত্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-৬৩০)
জালুলা ও নাহাওয়ান্দ : বিজয়ের বিজয়
ইসলামী বিজয়ের ধারাবাহিকতায় ১৮ হিজরিতে সংঘটিত হয় জালুলার যুদ্ধ। সাহাবিরা পারস্য সম্রাট ইয়াজদেগার্দ-এর বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন। ইমাম তাবারি (রহ.) লিখেছেন, সেদিন এক লাখ সৈন্য নিহত হয়, যাদের মৃতদেহ মাঠসহ তার আশপাশ সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছিল। এ কারণে ওই স্থানটির নাম হয় জালুলা। (তারিখুত তাবারি, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৬)
অবশেষে ২১ হিজরিতে নাহাওয়ান্দের যুদ্ধ হয় ইসলামের বিজয়ের চূড়ান্ত অধ্যায়। এই যুদ্ধে ইয়াজদেগার্দ পরাজিত হন। মুসলিমরা এ বিজয়কে আখ্যা দেন ফাতহুল ফুতূহ বা বিজয়ের বিজয় হিসেবে। (সূত্র: আল-বিদায়া ওয়াল-নিহায়া, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-১১১)
ইরানে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ
পারস্যের বিস্তৃত অঞ্চল ও দুর্গমতার কারণে পুরো অঞ্চল পুরোপুরি ইসলামী নিয়ন্ত্রণে আনতে মুসলিমদের প্রায় দশ বছর সময় লেগেছিল। এরপর শুরু হয় ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার। আরব গোত্রসমূহ বসতি স্থাপন করে, বিবাহসূত্রে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আর পারস্পরিক মেলামেশার ফলে গড়ে ওঠে এক নতুন ঐক্যবদ্ধ সমাজ।
সাসানীয় সাম্রাজ্যের (অহুর মাযদা, মাজদেয়ান ধর্ম) পতনের পর ইরান হয়ে ওঠে এক ইসলামী জ্ঞান-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। এখানেই জন্ম নেয় ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, গাজালি, ইবনে সিনার মতো মনীষাগণ। প্রায় ৯ শতাব্দী ধরে ইরান ছিল সুন্নি ইসলামের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি।
পরবর্তীতে ৯০৬ হিজরিতে শিয়া সাফাভি শাসকরা ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিকভাবে শিয়া মতবাদের প্রচলন শুরু করে। কিন্তু তার আগে দীর্ঘকাল ইরান ছিল খাঁটি সুন্নি সভ্যতার মাটি।
ইরানে ইসলামের আগমন সামরিক বিজয়ের চেয়েও ন্যায়, মুক্তি ও সংস্কৃতির বিজয় ছিল। প্রাচীন পারস্যের গৌরবকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, ইসলামের ছোঁয়ায় সে গৌরব নতুনতর রূপে বিকশিত হয়েছে। সত্য, ন্যায় ও ঐশী পথনির্দেশের এই আলোকবর্তিকা আজও ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুস সুন্নাহ মাদরাসা মাতুয়াইল, ডেমরা, ঢাকা
ডিএ